কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ - শুভজিৎ ব্যানার্জী
কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ
শুভজিৎ ব্যানার্জী
আলতো হাওয়ার দাপটে মুখের ওপর এসে পড়া এলোচুলগুলো সামলাতে সামলাতে তবস্সুম দু'চোখের তেপান্তর দৃষ্টিটা ভাসিয়ে দিলো অনাম্নী তুষারশুভ্র শৃঙ্গের দিকে। আজ নিয়ে ঠিক দশ দিন হয়ে গেল, শহরের রাজপথ ছেড়ে পাকদণ্ডীর মায়ায় আটকা পড়ে মেয়েটা যেন ছান্দিক জীবনকে হেলায় বিলিয়ে দিয়ে সৌম্যর পথ চেয়ে বসে আছে।
সৌম্য ভট্টাচার্য পেশায় সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্ব বিখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ম্যানেজার। আইআইটি মান্ডির স্বর্ণপদক প্রাপ্ত প্রাক্তনী। তবস্সুম নাসরিন সেই কোম্পানীর মানব সম্পদ বিভাগের মধ্যপদস্থ আধিকারিক। ধর্মীয় সংকীর্ণতা তবস্সুমের উদার চিন্তাধারাকে শাসনের নাগপাশে জড়িয়ে রাখতে পারেনি। বহুদিন সৌম্যর সাথে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা বাইরের কাউকে জানতে দেয়নি তবস্সুম বা সৌম্য।
সমস্যাটা শুরু হয়েছিল তবস্সুমের বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর থেকেই। প্রথমে নরমে গরমে দু'জনকেই আলাদা করতে চেয়েছে তবস্সুমের গোঁড়া পরিবার। কিন্তু দু'টো সবুজ মনকে অবদমিত করতে পারেনি। এরপর আরো উগ্রতার পথ বেছে নিয়েছিল তবস্সুমের বাবা, দাদা, মামারা। বিপদের জল যখন মাথা স্পর্শ করছিল তখন তবস্সুম একটা মেসেজ করে কলকাতার বাড়ি থেকে পালিয়ে নেপালের ঘ্রান্দুকে এসে পৌঁছয়। আরো একটি মেসেজ তার প্রাণাধিক প্রিয় সৌম্যর কাছে দিয়ে এসেছিল সে, ভালোবাসার বিশ্বাসে।
দশ দিন বাদেও যখন সৌম্য এলো না তখন তবস্সুম সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল। আর সামান্য ক'টা টাকা অবশিষ্ট আছে, মেরেকেটে এই সস্তার লজে দিন দু'য়েক সে থাকতে পারবে, তারপর? আর কিছু ভাবতে পারে না বছর সাতাশের সুন্দরী মেয়েটা।
সন্ধের একটা হাল্কা আঁধারের মধ্যে পাতলা মেঘের আস্তরণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে শতাব্দী প্রাচীণ অরণ্যানি। বুনো কাঠের সুবাস মেখে রাতজাগা ক্লান্ত দেহটা অবসাদে মুড়ে আসছে ধীরে ধীরে। নেটওয়ার্কহীন মোবাইলটায় মেসেজগুলো আবার ছুঁতে ইচ্ছে হল তবস্সুমের। সে তো সৌম্যকে জানিয়ে এসেছিল তার অজ্ঞাতবাসের সাকিন, তবে কি আর সে আসবে না? একটা অজানা জংলি ফুলের গন্ধে মনটা আরো ভারি হয়ে উঠল তার।
মিশমিশে কালো গভীর রাতটা তারাদের স্বপ্নালোকে বিভোর। থেকে থেকে বসে আসা হিমশীতল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠে নিদ্রিত শরীরটা নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নেয় কম্বল। অবচেতন মনের আনাচে কানাচে স্বপ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করছে সৌম্যর সাথে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দেওয়া ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোঁরার সন্ধেটা। তবস্সুমের অনামিকায় "এস" লেখা প্ল্যাটিনামের আংটিটা সেদিন পরম যত্নে পরিয়ে দিয়েছিল সৌম্য। ভালোবেসে সুমি বলে তাকে ডাকে সে। তবস্সুম কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিল তাকে, "কী দরকার ছিল এত দামের আংটি কেনার, কতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল বলো তো?" "তোমার চেয়েও দামি?", প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েই দেব আনন্দের মতো আলতো করে ঘাড়টা কাত করে ধর্মেন্দ্রর মতো মন ভোলানো দৃষ্টিতে সুশান্ত সিং রাজপুতের মত হাসছিল সৌম্য।
"সুমি"! ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল তবস্সুম। ডাকটা এত স্পষ্ট মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। আর একটু অপেক্ষা করে আবার ভেঙে যাওয়া মনটাকে বাগে আনতে আনতে ভোরের আলো উঁকি মারল কাঠের জানলার ফাঁক দিয়ে।
নিজেকে বড্ড খারাপ লাগতে শুরু করেছে আজ তবস্সুমের। অভিমান, কষ্ট, বেদনা সব অনুভূতিগুলো এক এক করে সরে গিয়ে এখন কেবল পড়ে আছে রাগ আর হতাশা। তবে কি সবটাই ভুল, সবটাই তার মনগড়া এক সম্পর্ক? সৌম্য কি আদৌ তাকে ভালবাসে?
চোমো নিংমা ডোলমা মনাস্ট্রির সিঁড়ি দিয়ে ধীরপায়ে উঠে আসছেন। অস্তগামী সূর্যের গেরুয়া আলো মুন্ডিত মস্তক মহিলা লামাকে আরো সুবিন্যস্ত ও সুগম্ভীর দেখাচ্ছে। স্মিত হেসে তবস্সুমকে উপাসনাগৃহের ভিতরে আসতে ইঙ্গিত করলেন। সব হারিয়ে তবস্সুম তখন অবলোকিতেশ্বরের পায়ে বাকি জীবনটা অর্পণ করে দিতে প্রস্তুত।
"সুমি"! ডাকটা মাথায় যেতেই ধীরপদে ফিরে দাঁড়ালেন নিংমা ডোলমা। তবস্সুম তখনও একটা একটা সিঁড়ির ধাপ উঠতে ব্যস্ত। এই ভ্রম তার বহু পরিচিত। বহুবার মনে হয়েছে চেনা নামটি ধরে প্রাণাধিক প্রিয় মানুষটা তাকে ডেকেছে। তাই এও সেই বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই না। মহিলা লামা শান্ত স্বরে তবস্সুমকে ডাকলেন। ডান হাতের তর্জনী লক্ষ করে ফিরতেই তবস্সুমের পায়ের নিচে মাটি কেঁপে গেল যেন, সৌম্য।
বিষ্ময়কর ভাবটা কাটতে কিছুটা সময় কেটে গেল। নরম গাল বেয়ে অশ্রুধারা ঝরে পড়তে লাগল। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত সৌম্যের শরীরটা ঠায় অপেক্ষমান। পড়ন্ত সূর্যের আলোতে আরও ম্লান দেখাচ্ছে সৌম্যর মুখটা।
ছুটে এসে সৌম্যের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল তবস্সুম, সৌম্যর সুমি। উপাসনাগৃহের অভ্যন্তরে তখন শুরু হল শান্তির আরতি। হাতে হাত ধরে দুটো মানুষ পরষ্পরের সাথে জীবন কাটানোর সংকল্প করল, মন্ত্রের সুরে, পাহাড় ঘেরা ছোট্ট এক গ্রামে। মায়ের দেওয়া সিঁদুরে সৌম্য রাঙিয়ে দিলো তবস্সুমের সিঁথি। মাতৃস্নেহে উপহারের ডালি হাতে আশীর্বাদ করলেন প্রধান চোমো নিংমা ডোলমা।
আজ রাতটা মিশমিশে কালো নয়, বরং অর্বুদ নক্ষত্রের আলোকে দেদীপ্যমান।
------সমাপ্ত------
লেখক পরিচিতি
শুভজিৎ ব্যানার্জী, উত্তর কোলকাতার উপকন্ঠে বরানগরের বাসিন্দা। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বানিজ্যে সাম্মানিক স্নাতক, সমাজ কর্মে স্নাতকোত্তর নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। নেশা, ভ্রমণ এবং সাহিত্য চর্চা। তিনটি বড় গল্প ও একটি গল্প ইতিমধ্যেই 'গল্পকথা' ইউটিউব চ্যানেলে পাঠ করে শোনানো হয়েছে। এছাড়া অনেক অণুগল্প ও কবিতা দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে।
Join the conversation