যামিনী রায়ের চিত্রকলা - স্বপন কুমার কর্মকার


      যামিনী রায়ের চিত্রকলা 

    স্বপন কুমার কর্মকার




বঙ্গের অঙ্গ বাঁকুড়া। 'লাল পাহাড়ির দেশ'- 'রাঙ্গামাটির দেশ'  হিসাবে পরিচিত এই জেলাটি  আবার শিল্প-সংস্কৃতির রত্ন ভান্ডার। শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বর্ধিষ্ণু এই গ্রামের বুক চিরে বাঁকুড়া দুর্গাপুর সড়ক পথটি সর্পিল  গতিতে এগিয়ে চলেছে। বড়জোড়া থানার এই সমৃদ্ধ ও  সুবিন্যস্ত গ্রামে ধর্মরাজের গাজন বেশ জনপ্রিয়, রসনা তৃপ্তির বাসনা মেটাতে মেচা সন্দেশের জুড়ি মেলা ভার, সম্প্রতি জি-আই ট্যাগ পেতে চলেছে। এই গ্রামে বাস করেন মৌমাছি কবিসহ গুণীজনেরা। গ্রামটির নাম -বেলিয়াতোড়। 

বিংশ শতাব্দীর এমন একজন শিল্পীর কথা আলোচনা করব যার সৃজনশীল প্রতিভা, রং ঢং, স্টাইল, নতুন আঙ্গিকের অভিনব শৈলী ইডিয়াস প্রভৃতি প্রয়োগ শিল্প জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি হলেন যামিনী রঞ্জন রায়।
 বাংলাদেশের যশোহর রাজের হত্যার আদেশ থেকে আত্মরক্ষার্থে মল্লভূম বিষ্ণুপুর রাজের স্বরণার্থী হন। মল্লরাজ জায়গীর দান করে।  দেওয়ান রাজ্যধর রায়ের বংশধর যামিনী রায়।  ১৮৮৭ সালের ১১-ই  এপ্রিল বেলিয়াতোড়ের সম্ভ্রান্ত রায় পরিবারে তিনি গ্রহণ করেন। পিতা রামতরণ রায় , মাতা নগেন্দ্রবালা দেবী। 
বাল্যকাল থেকে গ্রামের ক্রাফটম্যানদের কাজ তাকে অনুপ্রাণিত করত। অনুভূতিগুলি প্রথমে চিত্তে, পরে তা চিত্রে প্রকট হত। গ্রাম বাংলার অনাড়ম্বর সারল্য  জীবনযাত্রা প্রকৃতির রূপ, মানুষ,  পশু পাখি সহ বিভিন্ন ঘটনার খন্ডচিত্রগুলির কাছে শহরতলীর বিলাসবহুল উচ্ছৃংখল জীবনযাত্রা ম্লান হয়ে যায়।

কোলকাতার আর্ট স্কুলে পড়ার সময় প্রিন্সিপাল পার্শি ব্রাউন অধ্যাপক গিল হার্ডির জহুরী চোখ রতন চিনতে ভুল করেন নি । দাদার মেসে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শিল্প শিক্ষা লাভ করেছেন তিনি। বই  আড্ডি দোকানে বই পৌঁছে আনা চারেক পারিশ্রমিক পান ইহূদি ব্যবসায়ীর জন্য ১০০ টি রঙিন কার্ড একে ১০-১২ আনা প্রাপ্ত অর্থে ভাতের জোগাড় করেছেন, বটতলায় কঞ্চি বাশ ছুলেছেন, রোয়াকে বসে লিয়োর  কাজ করেছেন। শ্যাম বাজারে কাপড়ের দোকানে বসেছেন, নাটকের সিন এঁকেছেন।বরাত পেলে তেল রঙ এ প্রতীকৃতি একে দিতেন। এভাবেই গতিতে সমান্তরাল গতিতে চলত কর্ম এবং শিক্ষা। শিক্ষার্থী জীবনের এমন সব কৃচ্ছ সাধন ভাবিয়ে তোলে বিবেক নাড়িয়ে দেয়। প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। ক্লাস চলাকালিন একদিন পার্শিব্রাউন টহল দেবার সময় লক্ষ্য করেন যামিনী ক্লাস  না করে চৌরঙির দিকে জানালার খড়খড়ি তুলে দাড়িয়ে রয়েছে।সাহেব জিজ্ঞেস করলেন এখানে সময় নষ্ট করছো কেন? উত্তরে জামিনী বললেন সামনের প্রাকিতিক দৃশ্য আঁকতে হবে, তাই এই ছড়ানো দৃশ্যকে সীমায় না বান্ধলে তো ছবি হবে না, খড়খড়ি তুলে দেখলে সেটা হবে। অসীম কে সীমার মধ্যে বান্ধার প্রয়াস দেখে ব্রাউন সাহেব পিঠ চাপড়ে বললেন – This is way you are right Jamini, I am proud of You.

ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর হাত যশের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একজন পট্রেট আঁকিয়ে হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। প্রতিকৃতি অংকন  করে একধারে মান ও মানি দুইই লাভ করেছেন তিনি। অবন ঠাকুর মহর্ষির  পুরনো পোর্ট্রেট নতুন করে আঁকানোর জন্য যামিনীর জোড়াসাঁকোতে ডাক পড়ত। এছাড়াও বেশ কিছু পরিবারেও ডাক আসত। সিটিং প্রসেসে পোট্রেট আঁকার সময় ঘন্টার পর ঘন্টা শিল্পীর সামনে বসে থাকতে হয়। রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা পরপুরুষের সামনে আসতে বিব্রত বোধ করত। তাই শুরু হল ছবি দেখে পোট্রেট আঁকা। কেউ মারা গেলে গ্রুপ ছবির মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যক্তির ছবি বেছে নেওয়া, প্রয়োজনে পোশাক পাল্টানো প্রভৃতি সুবিধে। এই সমস্ত অদ্ভুত আবদারে যামিনী রায় বিরক্ত বোধ করতেন। দিনের পর দিন অজস্র পোট্রেট একে দুহাত ভরে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে পেটের খিদে  মিটেছে কিন্তু মনের খিদে  মেটেনি। কেননা এই  সমস্ত ছবি এঁকে নিজস্ব কল্পনা শক্তি বিকাশের অর্থাৎ ক্রিয়েটিভিটির অবকাশ  কম। তাই নতুনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া, এখানেই বিপত্তি, হোঁচট খেলেই ছন্দপতন 

সে সময় আকাদেমী পন্থী ও নব্যপন্থীদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ টানাপোড়েন চলছিল। তিনি অনুভব করলেন দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব রয়েছে, ছন্দ নেই। কোন গোষ্ঠীই রং-রেখা নিয়ে সেরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে না। তখন তিনি তৃতীয় পথের সন্ধানে বেরোলেন 

এই তৃতীয় পথ খুঁজতে গিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সর্বত্র ঢুঁড়ে বেরিয়েছেন অবশেষে ক্লান্ত হয়ে স্বদেশের মাটির গন্ধ ও সেকড়ের সন্ধান মেলে। গ্রাম বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের লৌকিক শিল্পকলার মোটিফে ত্রিমাত্রিক ছেড়ে দ্বিমাত্রিক ফ্লাট টেকনিককে গভীর বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরেন। তিনি খুব ভালোভাবে অনুভব করেছেন শিক্ষালয়ে ফর্মাল টেকনিক শেখায় রীতি শেখায় না। এটা সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। 
শিল্পচর্চা ও সাধনায়  মগ্ন হয়ে তিনি ভাংগা গড়ার খেলায় মেতে ওঠেন। পটল চেরা, দীঘল চোখের ঘটনাটিও বেশ ইন্টারেস্টিং। পুত্র অমিয়র অপটুহাতে আঁকার সময় মুখমণ্ডলের ভেতর চোখ একে উঠতে পারত না। এই কেজুয়াল ব্যাপারটিকে যামিনী রায় গুরুত্ব দিলেন আর সৃষ্টি করলেন এক অনবদ্য সৃষ্টি চোখের স্টাইল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত গানের লাইন 'সেই দুটি চোখ আছে কোথায়, কে বলে দেবে আমায়……। মনে হয় যামিনী বাবুই সেই চোখের হদিশ বা সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। আর আপামর দর্শক দু চোখ ভরে দুচোখ দেখে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। 

পোট্রেটের নিশ্চিত আয় ছেড়ে দুর্গম পথের কান্ডারী হওয়ার সময় কোন শিল্পী বা কোন শিল্পী গোষ্ঠী  তার পাশে দাঁড়ান নি। তার অবস্থা চরৈবেতি। সাত বছরের দৈন দশায় অর্থাভাবে অর্ধাহারে দিন কাটছে। এমনও দিন গেছে এক পয়সার মুড়ি কিনে সারাদিন খেয়েছেন খাইয়েছেন। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ায় শুধু উত্তর কলকাতায় ১৫ বার বাড়ি পাল্টাতে হয়েছে। ক্যানভাসের পয়সা না থাকায় পিচবোর্ডে,প্যাকিং বাক্সে,  টেলিফোন ডাইরেক্টরি বা নরম মলাটের উপর শিল্প সাধনা করতেন। রং কিনতে পারতেন না বলে ভেষজ উপাদান দিয়ে নিজে রং বানাতেন।
মহান এই শিল্পীর পাশে কেউ না থাকায় ১৯৩১ সালে নিজের উদ্যোগে বাগবাজারে একটি প্রদর্শনের আয়োজন করেন। বিধিবাম হওয়ায় কোন ভারতীয়র দেখা মেলেনি। অগত্যা এক বিদেশিনী স্টেলা ক্রামরিশ উদ্বোধক হিসাবে এগিয়ে এলেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সমালোচনার ঝড় উঠলেও প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক আর রামানন্দ বাবুর কন্যা শান্তা দেবী প্রদর্শনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ছাপেন। ১৯৩৫ সালে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীতে মা ছবিটি বিচারক মন্ডলী মতে পুরস্কৃত হয়। অবনীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে হে আলী পূর্ণ মন্তব্য করছেন অত: কিম যামিনী।সে সময় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মা ও মেয়ের ছবি কিনছেন। যা তার কাছে এক পরমপ্রাপ্তি।
তিনি কালীঘাটের ড্রয়িং ভেঙ্গে চুরে নতুন আঙ্গিকে গড়েছেন। কোমর অতিরিক্ত সরু, ভঙ্গিমা বঙ্কিম, হাত পা আঙুলে লতার ভাব, ছবির রেখা কড়া, বলিষ্ঠ,  অবয়বগুলি নকশা অলংকারে অলঙ্কৃত। টেম্পেরা রঙের ব্যবহার করে নবরূপে সৃষ্টি করলেন। 
তার আঁকা বেশকিছু চিত্র হলো হাতি, বিড়াল, মাছ মুখে বিড়াল, বাঘের পিঠে মানুষ, মা ও শিশু, নারী প্রতিমা, বৈষ্ণবী, যীশু, দধিমনন্থন প্রভৃতি। বেশ কিছু লিনোকার্ট ও উড কাটিং করেছেন। টোটেম ফিগার সিগারেট মুখে সাহেব এগুলি দারু শিল্পের উদাহরণ। 


যামিনী রায়ের শিল্পকলা কালীঘাটের পটের সঙ্গে পিকাসো এবং  মাদিপাসিয়ানির ছবির সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত। 
পরিশেষে তাই বলতে হয় যামিনী রায়ের শিল্পকলায় পদ্ধতি অভিনবত্ব সিগনিফিকেন্ট ফর্ম ভারতীয় চিত্রকলায় এর আগে কখনো দেখা যায়নি। আর চিত্রকলায় গগনচুম্বি সাফল্যের পর ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে অনিশ্চয়তার খাদে পড়ে যাওয়া বিরল দৃষ্টান্ত পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসে দ্বিতীয়বার ঘটেনি। ১৯৭২ সালের ২৪ শে এপ্রিল বর্ষিয়ান এই শিল্পীর জীবনাবসান হয়। শিল্পীর মৃত্যু হয় ঠিকই  কিন্তু তার সৃষ্টি গুলো চির অমর হয়ে থাকে।

                  ----সমাপ্ত----

                   লেখক পরিচিতি 

Mr.SWAPAN KUMAR  KARMAKAR. (Teacher/Artist).

Jhalda , Purulia