মধু চা ওয়ালার কথা - প্রবাল সেন


  

বেশ কয়েক বছর দিল্লিতে কাটিয়ে আমরা আবার চন্দননগর মহুকুমা শহরে ফিরে এসেছি পাকাপাকি ভাবে । এখানে এসে ঠিক করলাম আমার কাজ কর্ম আবার শুরু করব কিন্তু তার জন্য একটা বসার জায়গা চাই  যেখানে আমার অফিস চালু করতে  পারবো । নানান জায়গা খুঁজতে শুরু করলাম । এর মধ্যেই একটা ভাল সুযোগ এসে গেল। আমরা যে কমপ্লেক্সে থাকি সেখানকারই আবাসিক সান্যালদা আমাকে একদিন  বললেন ওনারা একটা সমাজসেবী সংস্থা চালাচ্ছেন কয়েক বছর ধরে এবং খুবই সাম্প্রতিক একটা ফ্ল্যাট বাড়ীর নিচে সংস্থাটি পরিচালনার জন্য একটি ঘর নেওয়া হয়েছে । এই ঘরটি কেনার জন্য টাকা সংস্থার সদস্যদের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদি লোন হিসাবে নেওয়া হয়েছে আর সংস্থার জমানো কিছু টাকা দিয়ে । এই ঘাটতি মেটাবার জন্য তিনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন মাসিক কিছু টাকার বিনিময়ে আমি ওই ঘরটিতে আমার অফিস চালু করতে পারি কিন্তু একটা শর্ত ছিল সংস্থার কাজের জন্য  বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা অবধি আমাকে কাজের সময় বাদ দিতে হবে । আমিও সেই সময় কাজের একটা অফিস ঘর খুঁজছিলাম তাই সময় নষ্ট না করে ওনার দেওয়া প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে  গেলাম। ওনাদের সংস্থাটি পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য চিন্তা ভাবনা করে থাকেন আর মানুষের মধ্যে সচেতনা গড়ে তোলার কাজ করে থাকেন । এই অফিস ঘরটি রাস্তার উপরেই ছিল । প্রায় প্রতিদিনই ১২-১৫ সদস্য সঠিক সময়ে আসত আর নানান গঠন মুলক আলোচনায় যুক্ত হতেন । আমিও কিছু দিনের মধ্যেই এই সংস্থার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হয়ে পড়লাম। সংস্থাটিতে ২-৩ মাস অন্তর নানান আলোচন সভার আয়োজন করা হত এবং যারা এই সভাতে উপস্থিত থাকতেন তাদের সকলের জন্য চা ও বিস্কুটের ব্যবস্থা করা হত। সেই সুত্রেই মধু চা ওয়ালার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল তাও ৯-১০ বছর হয়ে গেল । মধুর একটা ছোট্ট চায়ের স্টল ছিল মেন রাস্তার উপর। রোজ সকাল বিকাল বহু মানুষ মধুর দোকানে এসে দু দন্ড বসে কিছু সময় কাটিয়ে চা বিস্কুট খেয়ে যেত। দোকানটি ও বেশ অনেক বছরের পুরানো এবং সকলেই মধুর অমায়িক 


ব্যবহারের জন্য ওকে খুব ভালোবাসতো । এরপরে মধুর সঙ্গে আমার আরো অনেক বার দেখা হয়েছে। পারিবারিক কারনে আমি মানসিক প্রতিবন্ধীদের একটা সংস্থার সঙ্গে ভালভাবেই যুক্ত হয়ে পড়লাম। তারা প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েদের জন্য একটা স্কুল চালু করেছে । তাদের যতটা সম্ভব পড়াশোনা শেখানো যেতে পারে তার চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। পড়াশোনা ছাড়াও নানান হাতের কাজের উপর তাদের উৎসাহ দেওয়া হত যাতে ওরা জীবনের মূলস্রোতে কিছুটা স্বাবলম্বি হয়ে উঠতে পারে। ওখানেই ওদের সকলের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের একজন নিকট আত্মীয় এর ছেলেও অনেক বছর ধরে এই আবাসিক স্কুলে আছে । অনেক কিছু ভাল শিখেছে খুব সুন্দর গান গায় এবং নানান ফাংশনেও স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করে। হাতের কাজও ভাল শিখেছে এই কয়েক বছরে । ওই সংস্থা একটা বাৎসরিক অনুষ্ঠান করে আবাসিক স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের  নিয়ে। সেই রকম একটা অনুষ্ঠানে মধুর সাথে আমার দেখা হয়েগেল । তার কাছে  জানতে পেরেছিলাম তারও একটা বেশ বড় ছেলে আছে তবে সেও মানসিক প্রতিবন্ধী আর এই স্কুলেই আছে বেশ কয়েক বছর ধরে। আগে ছেলেটা কিছুই করতে পারত না এবং এই স্কুলে ভর্তি করার পর সে এখন অনেক উন্নতি করেছে। বাড়ীতে থাকলে ছেলেটার দেখাশোনা ঠিক মতন হয়ে উঠত না , এখানে থাকলে আর সকলের সাথে অনেক কিছু শিখতে পারবে ।আর বাড়ীতে থাকলে বাবা মায়ের  খুব চিন্তা হত তাকে নিয়ে। সেই সব চিন্তা করে ছেলেকে এই স্কুলে ভর্ত্তি করে দেওয়া হয়েছিল তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল । এখানকার ছাত্র ছাত্রীরা ৪-৫টা অনুষ্ঠান করে সারা বছর  ধরে । তাদের বাবা মায়েদের এই অনুষ্ঠান দেখে মন আনন্দে ভরে যায়। মধুর সঙ্গে এই সব অনুষ্ঠানে প্রায় দেখা হত । একবার তার ছেলের সাথে আমার পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিল। 

এর মধ্যে আরো দুই আড়াই বছর কেটে গেছে একদিন স্কুল কতৃপক্ষ সিনিয়র ছাত্র ছাত্রীদের বাবা মায়েদের জানালো যে বড় বড় ছাত্র ছাত্রীদের যাদের অনেক বয়স হয়েছে আর তাছাড়া তাদের আর কিছু শেখানোর বাকী নেই সেইজন্য তাদের আর স্কুলে ও 


৩ 

হোষ্টেলে রাখা হবে না সামনের মাসে থেকে । অভিভাবকদের এক মাস সময় দিয়েছে তার মধ্যে তাদের ছেলে মেয়েদের নিজ নিজ স্থানে নিয়ে যেতে হবে। এই নির্দেশ পাবার পর বাবা মায়েদের মাথায় হাত এবং তাদের দুশ্চিন্তাও হাজার গুন বাড়িয়ে দিল। কয়েকদিন পর জানা গেল কিছুটা দূরে একটা সমাজসেবী সংস্থা ‘পাটনার’ প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েদের নিয়ে একটা পাকাপাকি থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছে এবং বেশ কয়েকটা সীট খালি আছে। আমার মতো কয়েকজন মিলে ওখানে একদিন খোঁজ খবর নিতে গেলাম। জায়গা ও ব্যবস্থা দেখে খুবই ভাল লাগল,কিন্তু মাসে মাসে যা টাকা দিতে হবে সেখানে থাকা খাওয়ার জন্য সেটা শুনে মন খুব খারাপ হয়ে গেল। টাকার পরিমানটা বেড় বেশী ছিল। মধু সব শুনে বলল অত টাকা দিয়ে ছেলেকে ওখানে রাখতে পারার মত সামর্থ তার নেই । মধুর ছেলের মতন আরো কয়েকজন ও সেই থেকে বাড়িতে থাকতে শুরু করল । 

এরপর আরো দু তিন বছর কেটে গেছে। একদিন একজনেরে কাছে শুনলাম যে বারুইপুরে একটা সেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েদের নিয়ে হোম শুরু করেছে। ওখানকার সঠিক ঠিকানা ও অন্যান্য দরকারী বিষয়ে জেনে নিয়ে মধুকে খবর পাঠিয়ে সব জানালাম এবং মধুকে বললাম ও যেন একবার ওর স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে ওখানে গিয়ে সব দেখে আসে। সংস্থার সম্পাদককে মধুর আর্থিক অবস্থার কথা আগেই জানিয়েছিলাম । সবকিছু শুনে উনি মধুকে বলেছেন সব দেখে আসার জন্য সেই মতন মধু ওর স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে বারুইপুরের দিকে রওয়ানা হল । এরপর ফিরে এসে জানালো যে হোমের ব্যবস্থা দেকে সকলের খুব  ভাল লেগেছে আর তারা ঠিক করেছে ছেলেকে ওখানেই রেখে দেবে ।

এরপর শুনেছিলাম যে মধু তার ছেলেকে বারুইপুর হোমেই রেখে এসেছে । সে আর তার স্ত্রী  মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসে। একদিন শুনলাম মধু এখানকার চায়ের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। ছেলেকে দেখতে না পেয়ে মধুর স্ত্রীর খুব মন খারাপ করে থাকে আর কান্নাকাটি ও করে সবার অলক্ষে । কিন্তু ব্যবসা ছেড়ে 


 তা বলে  আর তো ঘনঘন বারুইপুরে গিয়ে দেখে আসা যায় না । পরে এখানকার চায়ের দোকান বন্ধ করে বারুইপুরে হোমের সামনে একটা চায়ের দোকান দিয়ে মধু তার স্ত্রীকে নিয়ে তার ছেলের হোমের কাছাকাছি থাকা শুরু করল ।

এরপর মধুর আর কোন খবর আমার কানে আসেনি । তবে এখনো নানাজন ওর ব্যবহারের সুখ্যাতি করে আর মনে করে যে ও ওখানে শান্তিতেই আছে ছেলের কাছাকাছি গিয়ে থাকছে বলে ।

   ----সমাপ্ত----

লেখক পরিচিতি 


প্রবাল সেন -  জন্ম দেশের রাজধানী দিল্লি ১৯৪৮ সনে। ছোটবেলা থেকে বড়ো হয়ে ওঠা এবং পড়া শোনা সবই বাঙালি পরিবেশে  । চাকুরী জীবন শুরু হয়  মীরাট শহরে । কর্ম উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে গমন ও থাকা । সেই সব স্থানের মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পরিভ্রমণ কে পাথেয় করে  আমার সাহিত্য জগতে প্রবেশ । মূলত ভ্রমণ কাহিনী লিখলেও গল্প, জীবনী এবং স্মৃতি চারণ নিয়েও লেখালেখি করে থাকি ।

পেশা ভিন্ন হলেও নেশা আমার দেশ বিদেশ দেখা । বর্তমানে হুগলির  মহকুমা শহর চন্দননগরে  পাকাপাকি ভাবে থাকা হয়।