মুখার্জী মাসিমা - প্রবাল সেন (দীপু)
মুখার্জী মাসিমা
প্রবাল সেন (দীপু)
মুখার্জী মাসিমার মতন সহৃদয়া ও পরপোকারি মহিলা আমি ও আমার মতন অনেকেই যারা ওনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন সে সময় এক বাক্যে স্বীকার করতেন যে ওনার মতন মানুষ খুঁজলে খুব কমই পাওয়া যাবে। মুখার্জী মাসিমার সঙ্গে পরিচয় আমাদের গুন্টুরে থাকতে হয়। তখন আমি ও আমার পরিবার দিল্লী থেকে ঐ যায়গায় বদলী হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি প্রথম এক দু মাস একাই ছিলাম। বাড়ী দেখে এবং ঠিক করে পরিবার আনব। ওখানে গিয়ে প্রথম প্রথম কষ্ট হত কথা বলার সঙ্গী পাওয়া যেত না। আর কত ইংরাজীতে কথা বলা যায়। আর কত লোকই বা ইংরাজী বলতে পারে। স্থানীয় ভাষা তেলেগু। বেশীর ভাগ লোকই তেলেগু ভাষায় কথা বলে থাকে। কিছু কিছু লোক অবশ্য হিন্দী বলতে পারে পরে তা পরে জানতে পেরেছিলাম। ওখানে যে বাঙালীর দেখা পাবো আশা করিনি। একদিন আমি Bank এর নীচে এসে দেখি যে সামনের রাস্তায় একটা দু পায়া স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে। ঐ স্কুটারের নম্বর প্লেটের নীচে এন সি ঘোষ লেখা আছে। আমি ঐ নাম দেখে আমার মাথায় বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি সে সময়। এই দেশে অনেক তেলেগু লোকেরা সুভাষ চন্দ্র বোস ও শরৎচন্দ্র চক্টোপাধ্যায় এর দেশের প্রতি অবদানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তারাও চাইতেন নিজের বাড়ীর ছেলেদের নাম ও ওনাদের নামে পরিচিত হতে। দু তিন দিন পর নীচে নেমে দেখি ঐ স্কুটারটি রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। এর কয়েকদিন পর নীচে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় একজন ভদ্রলোক পেন্টের উপর বাটিকের কাজ করা পাঞ্জাবী পরা আমার কাছে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাকে বললেন উনি এই শহরে বেশ কয়েক বছর ধরে বউ দুই ছেলে নিয়ে থাকেন। এখানেই একটা বাড়ি করেছেন এবং বাড়ীতেই নীচের তলায় একটা ফেক্টরী (Factory) মতন করেছেন। ভদ্রলোকের নাম নীরদ চন্দ্র ঘোষ। ওনারা প্রসিদ্ধ ঘোষ ডেয়ারীর ঘোষেদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। এখানেই ঘি এর ব্যবসা করেন। ওনাকে দেখে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল উনি একজন তেলেগু ভদ্রলোক। যেমন গায়ের রঙ তেমন চেহারার গঠন, তা দেখে স্থানীয় তেলেগু বলেই যে কেউ ধরে নেবে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো উনি যখন পরিষ্কার বাংলায় আমার সাথে কথা বলছিলেন। আমি একটু ও ভাবিনি যে এখানে কোন বাঙালী পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে। কথা আর একটু এগোলে তখন বললেন যে এখানে ১০-১২ জন বাঙালী পরিবার আছেন। এক দুজন রেলের কর্মচারী ৫-৭ জন তুলো (Cotton) ও লাল লঙ্কার এবং তামাকের ও বাকী কয়েকজন ঘি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আরও বললেন গুন্টুরে খুবই ভাল তুলো, লাল লঙ্কা, তামাকের চাষ হয়, ঘি এর নাম তো ভারত জোড়া। গুন্টুর ঘি নামে খুবই প্রসিদ্ধ আছে অনেকদিন ধরে। সেই সূত্রে কলকাতা থেকে অনেক বাঙালীর আসা যাওয়া লেগে থাকে সারা বছরই। নীরদবাবু গত ১৬-১৭ বছর ধরে বাড়ীতেই ঘি তৈরী করে পাঠান কলকাতায়। তা ছাড়া এখানেও ঘি এর একটা বড়ো বাজার আছে। আগ মার্কার অফিস ও আছে। আগ মার্কার হেড অফিস কলকাতায়। ওখান থেকে মাঝে মাঝে ইন্সপেকশনের জন্য লোক পাঠায়। আমি থাকার জন্য একটা বাড়ী খুঁজছি জেনে বললেন যে ওনার জানাশোনা একজন বাঙালী ভদ্রলোক কলকাতা বদলী হয়ে গেছেন। ওনার পরিবার এখনো এখানেই আছে। ওনাদের থেকে সঠিক জেনে আমাকে দু একদিনের মধ্যেই জানাবেন। ঘোষবাবুর সঙ্গে এরপর প্রায়শই দেখা হত। উনি নিজের কাজের জন্য রোজই আমাদের ব্যাঙ্কের নীচে আসতেন এবং স্কুটারটি রাস্তার একধারে রেখে নিজের কাজে যেতেন। কয়েক দিনের মধ্যে আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন যে ঐ ভদ্রলোক কলকাতা থেকে এসেছেন । দু একদিনের ভিতর ওনারা সপরিবার কলকাতায় চলে যাবেন, তার মধ্যে আমি ইচ্ছা করলে ওনার বাড়ীটা দেখে আসতে পারি। ঠিক হল উনি আমার সাথে গিয়ে বাড়ীটা দেখিয়ে নিয়ে আসবেন ও কথা বলিয়ে দেবেন বাড়ীওয়ালার সঙ্গে। পরের দিনই আমরা ঘোষ বাবুর সাথে বাড়ীটা দেখত গেলাম এবং বাড়ীটা দেখে আমার পছন্দ হয়ে গেল আর ঠিক করলাম এই বাড়ীতেই আমার পরিবারকেও নিয়ে আসব। সব কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। তার কয়েকদিন পর দিল্লী গিয়ে আমার পরিবার ও জিনিষপত্র নিয়ে ঐ বাড়ীতে চলে আসলাম। বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে একদিন সকালে আমার অফিস যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরা আমার সাথে দেখা করতে এলেন। ইনি মুখার্জী বাবু। আমাদের পাশের পাড়ায় আউন্ডেলপেট সেকেন্ড লেনে থাকেন নিজ পরিবারের সঙ্গে গত ২৫/২৭ বছর ধরে এখানে আছেন । কোন ঘি সংস্থার সঙ্গে অনেকদিন ধরে যুক্ত, উনি সেদিন আমাদের সাথে আলাপ করে একদিন ওনার বাড়ী যেতে বললেন। সেই মতন আমরা ওনার বাড়ী গিয়েছিলাম এবং সেখানে মুখার্জী মাসিমার সঙ্গে প্রথম দেখা হল। বেশ বয়েস হয়েছে। মহিলার কিন্তু মুখের হাবভাব দেখে তা বোঝার কোন উপায় রাখেন না। প্রথম দিনই উনি আমাদের খুব আদর করে কাছে টেনে নিলেন আমার স্ত্রী ও দুই শিশু পুত্রকে। বিদেশেও এ রকম বড় হৃদয়ের হাসি খুশী মহিলার সাথে আলাপ হবে ভাবাই যায় না। আমরা দুই আড়াই বছর গুন্টুর থাকতে ওনাদের সঙ্গে খুবই নিবিড় ভাবে যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের একে অপরেরে বাড়ী যাওয়া আসা পুরোদমে চলতে থাকল। শীতের সময় আমরা চার পাঁচ পরিবার মিলে গাড়ী করে বাপাটলা (Bapatla) বলে একটা সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলাম বেশ কিছু সময় কাটাতে । এখানে সমুদ্র খুবই শান্ত এবং অনেক দূর পর্যন্ত নিশ্চিন্তে যাওয়া হয়েছিল সকলের। সকলেরই সেদিন খুব ভাল কেটেছিল। আর একবার গুন্টুর ও বিজয়ওয়াড়ার মাঝে মঙ্গলাগিরি বলে একটা যায়গায় গিয়েছিলাম। মঙ্গলাগিরিতে পাহাড়ের উপর ভারতবর্ষের একটা বিরল মন্দির আছে “হিরণ্যকশীপুর” এর নামে ওখানে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয় এবং মন্দির দর্শন করতে হয়। এখানে এসে মন্দির দর্শন করে দেখলাম যে এখানে আরাধ্য দেবতা (হিরণ্যকশীপুর) ভোগ হিসেবে শুধু গুড়ের রসই নিবেদন করা হয়ে থাকে। আর একটা মজার ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম যা জীবনে আর কোথাও দেখিনি বা এমন কথা শুনিনি। সেটা হল ভক্তেরা যখন গুড়ের রস নিয়ে ঠাকুরকে নিবেদন করার জন্য নিয়ে আসে তখন পুরোহিত মশাই সেটা নিয়ে মুর্তির মুখে তা ঢেলে দেয়। কথিত আছে যে বিগ্রহ গুড়ের রস পান করেন যতটা ওনার আগ্রহ থাকে ততটাই। যখন আর নৈবেদ্ধ গ্রহন করতে ইচ্ছুক নন তখন গুড়ের রস আর মুখে নেন না। এ সব ভক্তদের চোখের সন্মুখেই হয়। সবই বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার। তবে খুবই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া আর একটা জিনিষ শুনলাম যে এখানে শ্রী চৈতন্যদেব মহাপ্রভু এসেছিলেন ও মন্দির দর্শন করেছিলেন। ওনার পদ যুগলের চিহ্ন খোদাই করা আছে পাথরের উপর। বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ব্যাপার এসে যায়। এর মধ্যে মুখার্জীবাবুরা আগের ভাড়াবাড়ী ছেড়ে আমাদের বাড়ীর কাছে আর একটা নতুন বাড়ীতে চলে আসেন। কিন্তু দু তিন মাসের মধ্যে ছেলে কাছাকাছি কাডাপ্পা নামে এক যায়গায় চাকরী নিয়ে চলে যায়, মুখার্জীবাবুর তখন বেশ বয়স হয়েছে। উনি আর এই বয়সে আলাদা ভাবে আর থাকতে সাহস পেলেন না । উনি ও মাসিমা সব জিনিষ পত্র বিক্রি করে নিঃস্ব হাতে ছেলের কাছে চলে গেলেন। আমরা যে বাড়ীতে থাকতাম সেটা একটা পুরানো আমলের বাড়ী ছিল ও অনেক অসুবিধার মধ্যেও থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু যখন মুখার্জীবাবুরা ছেলের কাছে চলে গেলেন তখন আমরা ওনাদের ছেড়ে যাওয়া বাড়ীতে চলে আসলাম। সত্যিই খুব ভাল খোলামেলা বাড়ী ছিল। দোতলায় চারিদিক খোলা আলো বাতাস ২৪ ঘন্টাই প্রচুর পাওয়া যেত। এ বাড়ীতেও আমাদের ও বেশী দিন থাকা হল না। আমি এর পর তিন/চার ঘন্টার দুরের শহর ওয়ারাংগল শহরে বদলী হয়ে গেলাম এবং আমার সঙ্গে আমার পরিবারও গেল। ওখানে থাকার কিছুদিন পর ঘোষবাবু আমাদের জানালেন মুখার্জীমশাই মারা গিয়েছেন। উনি ওনার দেহ সৎকার দাহ না করে স্থানীয় মেডিকেল কলেজকে দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। শুধুই এটাই না চক্ষু ও কিডনি দিয়ে যাবার অঙ্গীকার পত্র সই করে গিয়েছিলেন মারা যাওয়ার আগে। মুখার্জী মাসিমা সবই তার ইচ্ছা মতন করেছিলেন। তিনি শ্রাদ্ধ করার ও বিরোধিতা করতেন জীবন কালে সেই মতন মুখার্জী মশাইয়ের শ্রাদ্ধও বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয়নি বলে পরে জানতে পেরেছিলাম। মুখার্জী মাসিমার সাথে আর দেখা হয়নি। কিন্তু নানান জনদের কাছ থেকে ওনাদের খবর পেতাম। মুখার্জী মাসিমা শেষ বয়সে খুবই কষ্টে দিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন।
পুনশ্চ : এখানে আমি মুখার্জী মাসিমার নিজস্ব বিগত জীবনের কথা আর লিখতে পারলাম না যা আমরা ওনার নিজের মুখ থেকেই বেশ কয়েকবার শুনেছি। ওনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই এটা লিখতে বাধ্য হলাম। একটা কথা খুব সত্যি যে জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে যা কাউকে না বললেই ভালো। সেটাই মঙ্গলের। গান্ধীজীর একটা কথা খুবই দাগ কাটে মুখার্জী মাসিমার জীবন কাহিনী শুনে ‘ A Man of truth must be a man care’। তাই ওনার জীবন কাহিনী আর সর্বসম্মুখে না বলাই শ্রেয় মনে করে তা থেকে বিরত থাকলাম। পাঠকবর্গ আমাকে মার্জনা করে দেবেন আশা করি।
----সমাপ্ত----
লেখক পরিচিতি
_
জন্ম , ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা এবং ছাত্র জীবন সবই পুরনো ও নয়া দিল্লিতে । চাকুরী জীবনের শুরু মিরাট শহরে এবং কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে । সেই সব অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে সাহিত্য জগতে প্রবেশ । মূলত ভ্রমণ কাহিনী লিখলেও গল্প , মনীষীদের জীবনী ও পুরনো দিনের স্মৃতি কথাও লেখা হয় ।
প্রবাল সেন (চন্দননগর )
Join the conversation