নীরব অভিভাবক - দেবার্পন চক্রবর্তী




         *নীরব অভিভাবক*
            দেবার্পন চক্রবর্তী


প্রতি বছরই  দুর্গাপূজার সময় শহর বদলে যায়।আলোর ঝলকানি,ঢাকের শব্দ এবং উচ্ছ্বসিত জনতার  ভিড়ে শহরটাকে আচ্ছন্ন করে তুলে। দুর্গাপূজা হল জয়ার কাছে উৎসবের চেয়েও বেশি কিছু,এই সময় শিউলি ফুলের পরিচিত ঘ্রাণ এবং ঢাকের ছন্দময় স্পন্দন তার হৃদয়কে এমন উষ্ণতায় ভরিয়ে দেয় যা অন্য কোন সময় হয়না।

 জয়া, একজন শিল্প ইতিহাসবিদ, তাই সে স্বভাবতই প্যান্ডেলের জটিল কারুকার্য, পূজার জন্য নির্মিত কাঠামোর প্রতি আকৃষ্ট হয় সবসময়।আজ নবমী,জয়া আজ তার পাড়ার প্যান্ডেলে বসে দুর্গা মূর্তিতে শিল্পীর সৃজনশীলতা,বেশ মন দিয়ে খুটিয়ে দেখছিল,এমন সময় সে অদ্ভুত কিছু একটা লক্ষ্য করে। মূর্তির গায়ে করা নকশাগুলিতে সূক্ষ্মভাবে বোনা একটি লাল রঙের হাতের ছাপ,যা খুটিয়ে না দেখলে বুঝা যায়না।

কৌতূহলী, জয়া এর অর্থ বুঝার জন্য এই প্রতিমা শিল্পী,এই পাড়ারই রামমোহনের সাথে কথা বলে এই ব্যাপার নিয়ে।এর উত্তরে তিনি বলেন যে প্রতিমা নির্মাণের সময় একদিন তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান,  তাই তিনি এটা প্রতিমায় যোগ করেন,এর বেশী তিনি আর কিছুই জানেন না।এই কথা শুনার পর জয়ার কেমন যেন একটা কৌতূহল হল,তাই সে নবমীর রাতে পূজো দেখতে না বেরিয়ে, হিন্দু শাস্ত্রের পৌরাণিক পুথিগুলি ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাটতে লাগল।তার মনে শুধু একটিই প্রশ্ন বার বার ঘুরপাক খাচ্ছিল,যে দেবী কেন রামমোহনদাকে এমন স্বপ্নাদেশ দিলেন,এর পিছনের রহস্য কি তা তাকে জানতেই হবে। অনেকক্ষণ বিভিন্ন পৌরাণিক পুথি ঘাটাঘাটির পর, হঠাৎ একটি বিস্মৃত পাণ্ডুলিপিতে সে যা আবিষ্কার করল তাতে সে অবাক হয়ে গেল,এই রক্তহস্ত যে একজন বিস্মৃত দেবীর প্রতীক, তিনি হলেন ভাগ্যের দেবী।প্রতীকটি অবস্থান অনুযায়ী সৃষ্টি এবং ধ্বংস উভয়েরই পূর্বাভাস দেয় বলে বিশ্বাস করা হয়।আর মূর্তির গায়ের কারুকার্যতে প্রতীকটির অবস্থান ধ্বংসের পূর্বাভাস দিচ্ছে।পরদিন,দশমীর বিসর্জনের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়েছিল জয়া, তার হৃদয় কাঁপছিল কি জানি দেবী কি ধ্বংসের পূর্বাভাস দিতে চাইলেন!বিসর্জনের ঘাটের পাশে লোকে লোকারণ্য  হয়ে আছে, ট্রাক থেকে মূর্তি নামানো চলছে,কিন্ত উদ্বিগ্ন জয়ার চোখ চারপাশে ঘুরছিল,তার মনে শুধু একটিই ভয় দেবী কি ধ্বংসের ইঙ্গিত দিয়েছেন।জয়া দাড়িয়ে এইসকল কথা ভাবছিল, হঠাৎই তার চোখে পড়ল এক ঝাকড়া চুলওয়ালা ছেলে বিসর্জনের  ঘাটের  কাছে একটি কালো সুটকেস রেখে পালালো।তখন মূর্তিগুলিকে নদীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক থেকে নামানো প্রায় শেষ,এখনই  তারা মূর্তিগুলি কাধে তুলে নদীর ভাসান ঘাটের  দিকে যাত্রা করবে,এমন সময় জয়ার কিযে হল,সে নিজেও জানেনা,সে দৌড়ে গিয়ে সেখানে উপস্থিত পুলিশ কর্মীদের তার  দেখা ছেলেটির কর্মকাণ্ডের কথা বলল।তার কথা শুনে পুলিশেরও এই কালো সুটকেসের ব্যাপারে সন্দেহ হওয়ায়,তারা নিরাপত্তার খাতিরে কিছুক্ষণের জন্য ভাসান থামিয়ে দিয়ে ভাসানঘাটের পাশে সেই কালো সুটকেসটা যেখানে পড়েছিল তার  থেকে মানুষদের নিরাপদ  দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে এলেন। বোমস্কোয়াডকে ডাকা হল,তারা এসে পরীক্ষা করে দেখেন যে সত্যিই এই সুটকেসে টাইম বোম রাখা। পুলিশ বোমটা সময় মত ডিফিউজ করলেন।এরপরে পুলিশের তরফ থেকে জয়াকে তার উপস্থিত বুদ্ধি ও সময় মতো পুলিশের এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এবং এত লোকের  প্রাণ বাঁচানোর জন্য অভিনন্দন জানানো হল।

অবশেষে আরও কড়া নিরাপত্তার সাথে বিসর্জন আবারও শুরু হল,দুর্গা প্রতিমার শেষ আভাস নদীতে বিলীন হওয়ার সাথে সাথে জয়ার মনে শান্তির অনুভূতি ভেসে উঠল। জয়া দেবী দুর্গার এক ভুলে যাওয়া রূপের শক্তি অনুভব করছিল,একজন নীরব অভিভাবক যিনি তার সন্তানদের বাঁচাতে  জয়াকে উনার বার্তা বাহক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।আজ দেবীর  কৃপায় এতগুলো নিরপরাধ  মানুষের প্রাণ রক্ষা পেল। জয়া মনে মনে দেবী, যিনি একজন নীরব অভিভাবক,উনার উদ্দেশ্যে নিজের হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করল।জয়ার চোখে তখন জল,এই চোখের জল হয়তবা দেবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এর দরুন নির্গত হচ্ছে অথবা দেবীর বিসর্জনের জন্য।

                          ( সমাপ্ত )

                     লেখক পরিচিতি

Debarpon chakraborty, c/o:Bijit Das,House No:23,Ramcharan Lane(Near meherpur petrol pump),Meherpur,city:silchar,Dist:cachar,state:Asaam,pin:788015,phn:9365141733