গন্ধ - কাকলি ভট্টাচার্য


 



           গন্ধ

 কাকলি ভট্টাচার্য


পুজো এলেই বাতাসে অন্যরকম গন্ধ পাই।

সারাবছরের গন্ধ নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সৌরভ।
   আমি সকালের শিউলি আর রাতের শিউলি হাতে নিয়ে দেখেছি, একেবারেই আলাদা সুবাস।
পাতায় পাতায় শিশিরের ঝলমলে টলটলে স্নিগ্ধতার গন্ধ। 
আলমারি খুললে নতুন কাপড়ের গন্ধ।
   রান্নাঘরে নীল-সাদা তুলোর মতো মেঘের গন্ধ পাই।
জানালায় উঁকি দিয়ে যায় পাখির ডানা।
এই ডানায় রোদের গন্ধ।
   পুজোর দিনগুলি ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী নানান ধরনের মানুষের গন্ধ।
নানারকম সুখদুঃখের আদানপ্রদানের গন্ধ পাই। 
ধুনুচির ধোঁয়া প্রদীপের আলোর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে
   আনন্দের গন্ধে মাতোয়ারা।
দশমীতে আসে মায়ের বিদায়বেলার গন্ধ।
বিষাদের গন্ধে মৃন্ময়ী দুর্গার চলে যাওয়ার বার্তা।
   ঘরে ঘরে কন্যারা আদরিনী এই কারণেই।
বেশিদিন ধরে রাখা যায় না যে।
ঘরময় ছড়িয়ে থাকে মেয়ের গন্ধ।
  বিজয়া সেরে শিবের জায়া কৈলাসে ফিরে আসেন।
   এই উৎসবের আমেজ রেখে বাড়িতে বাড়িতে নারকেল নাড়ু, নিমকি, মোয়া ইত্যাদি খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে।
বিজয়া মানেই মিষ্টির গন্ধ। 
কোলাকুলি করে ভ্রাতৃত্বের গন্ধ মাখা।

এইসব বিভিন্ন ধরনের গন্ধের মাঝে আমি ফিরে যাই ছেলেবেলায়। 
 গন্ধ বললেই সবার আগে মনে পড়ে মায়ের গায়ের গন্ধ।
      সন্ধ্যাবেলার ধূপ জ্বালিয়ে দেওয়া মা, কামিনী ফুল আর পাউডার মেশানো মাদকতা নিয়ে হেঁটে যেত, অপূর্ব আবেশে বিহ্বল গন্ধ।
মায়ের আঁচলে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সুগন্ধি।

    ভালো লাগত পেন্সিল কেটে রাবার দিয়ে মোছার গন্ধটা।
কেমন যেন শৈশবের গন্ধ।
    পেট্রোল পাম্পের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পেট্রোল নিলে দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে গন্ধ নিই।
 মনে হয় - - - - 
      হাওয়ার কণ্ঠে চিরকুট--
   যত আশ্বাস ছিল
   আজ সবাই লজ্জিত! 
    যত চোখের জল 
মনে হয় অতিথি অনাহুত। 
   একটি পরিত্যক্ত জমির বুকে
   আকাশের ছবি আঁকা 
কেবলমাত্র ক্ষণিকের তৃষ্ণা
মেটানোর তাগিদে--
গোটা জীবন রোদস্নানে
 দাঁড়িয়ে থাকা।

   এবার আসি জীবনের গন্ধে।
বিয়ের গন্ধ, ফুলশয্যার গন্ধ সবই তো বড়ো হয়ে ওঠার ছাড়পত্র।
প্রথম মা হবার গন্ধে গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ।
আসলে সব গন্ধই আলাদা।

হাসপাতালের গন্ধে অদ্ভুত একটা উদ্বেগ পেতাম, তুলনায় শ্মশানের গন্ধ ম্রিয়মান।
নম্বর দেখে চিতায় তোলার তাড়াহুড়ো। 
প্রিয় কেউ হারিয়ে যাওয়ার তীব্র গন্ধে ছেয়ে যায় আকাশ।

    আত্মীয় সমাগমে প্রিয়জনের পরশগন্ধ পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। 
  নতুন জুতোর গন্ধ ভীষণ ভালো লাগত। 
আতরের গন্ধ যেদিন প্রথম পাই---মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তার দেখি আর শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহর পতনের গন্ধ মিশে যায়। 
ইদানিং ধর্ষণের গন্ধ চারিদিকে।
জয়ের গন্ধে অদ্ভুত পরাজয় দেখি। 
  রক্তের অদ্ভুত গন্ধ।
গোলাপের গন্ধে উগ্রপন্থী হাওয়া।
  বারুদের গন্ধে সন্ত্রাস।
মানুষের গন্ধে অবিশ্বাস। 

   পুজোসংখ্যা বইয়ের আলাদা গন্ধ।
ঘরের বইগুলোর থেকে ভিন্ন গন্ধ ওদের।
পুজো পুজো গন্ধমাখা শারদসংখ্যা।
ঘরের বই আটপৌরে নারী হয়ে শারদসংখ্যার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। 

প্রথম প্রেম আসে কান্তা সেন্টের গন্ধের সাথে।
   বন্ধু আর প্রেমের ভুমিকা বদল করে দিয়েছিল কান্তা সেন্ট আর রুনা লায়লার কণ্ঠস্বর।
বহুদিন আগের ভেসে আসা সদ্য যুবতী গন্ধ।
হঠাৎ সেদিন দোকানে গিয়ে নানান সুগন্ধি দেখতে দেখতে কান্তার গন্ধ পেলাম।
  সামনে এলো কয়েক যুগ আগের দুই বেণীর সেই কিশোরী।
    জিজ্ঞেস করলাম দোকানিকে - -
এখনও পাওয়া যায় কান্তা?
দোকানি হেসে বললেন - - সব কিছুই সবসময় পাওয়া যায়, কেবল চাইতে হবে, সুপ্ত খোয়াবনামা ঘুমিয়ে আছে অন্তরেই।
অথচ আধা প্রৌঢ় জীবনের গন্ধে আত্মবিশ্বাসটাই তো ফিকে।
     বোধকরি যুগের পর যুগ ধরে গন্ধ বদল হয়।
আজ প্রেমের গন্ধে পুজো মিশে গেছে।
    মনে হয়, তাকে না পাওয়ার বিরহে অনেকখানি পাওয়া।
আগমনীর আগমন আবহমানকাল ধরে বহমান।
মহাকালের রূপ পরিবর্তিত হয়।
  আজ যিনি ঘটমান বর্তমান আগামীকাল তিনিই পুরাঘটিত বর্তমান।
মৃন্ময়ী মা কিন্তু অবিচল।
মহাকাল বলে দেয় পৃথিবীর রুপ রস গন্ধ উপভোগ করার সময় নির্দিষ্ট করা।
তুমি তোমার লক্ষ্যে এগিয়ে চলো।
দ্বন্দ্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো কাজ সফল হয় না।
   বিজয়ার গন্ধে তাই কোলাকুলির বার্তা।
বিদায় শব্দের অর্থ গভীর।
দায় কিন্তু অস্বীকার করা যায় না।
মা দুর্গা তাই প্রতিবছর প্রথামত আসেন।
আমাদের ভেতরের আমি-কে জাগিয়ে দিতে।
    ক্ষণিকের সত্য উন্মোচনে জীবনের সব প্রতিকূলতা জয় করার গন্ধ নিয়ে।

                 ---সমাপ্ত---

              লেখক পরিচিতি

 Kakali Bhattacharyya

জন্ম ঝাড়খণ্ডে।
লেখাপড়া ওখানেই।
ছোটো থেকে লেখালেখির সাথে যুক্ত।
একাধিক বইতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
কলকাতায় বাড়ি।
শ্রুতিনাটক করি ।
মঞ্চে পারফর্ম করি।