এক বীর শহীদের জীবন গাঁথা - প্রবাল সেন
একটা ফুল ফুটেই ঝড়ে পড়ে গেল। খবরটা জানতে পেরে মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয় গিয়েছিল বেশ কয়েকদিন । ছেলেটি ১২ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল প্রাথমিকে গ্রামের স্কুলে পড়ে পার্শ্ববর্ত্তী শহরে। ছেলেটি আমাদের ই গ্রাম বাংলার ছেলে। আর্থিক দুঃরাবস্থার কারনে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাড়ীতে থেকেই চাকুরীর চেষ্টা করতে লাগল আর নিকটবর্ত্তী বড় শহরে সেনা বাহিনীর অফিসে গিয়ে কাজের জন্য নিয়মিত খোঁজ খবর নিতে থাকে। একদিন সেনা বাহিনী অফিসে গিয়ে জানতে পারল নোটিশ বোর্ডে সেনাবাহিনী কাজে যোগদান করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের আবেদন পত্র এবং দৈহিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছে । গ্রামের দু চারজনের সঙ্গে সুবোধ ও একদিন ওখানে গিয়ে আবেদন পত্র জমা দিয়ে মৌখিক, দৈহিক ও মেডিকেল পরীক্ষা দিয়ে এসেছে । সুবোধের বয়স কম,চেহারাও বেশ ছিপ ছিপে ও লম্বা । এর ঠিক মাস দেড়ক পরে তাদের গ্রামের বাড়িতে সুবোধের নামে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এসে পৌছায়। চিঠিতে সুবোধকে ৭ দিনের মধ্যে সেনা অফিসে রিপোট করতে বলা হয়েছে। এই সুসংবাদ সুবোধের বাড়িতেই আনন্দের ঢেঊ বয়ে গেল ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকুরী পেয়েছে। তাদের গ্রামের প্রতিবেশীরাও খুব খুশী হয়েছে সুবোধ সেনাবাহিনীতে চাকরী পেয়েছে বলে। সেনা ইউনিফর্ম পরে সুবোধকে খুব সুন্দর দেখাছিল । একদিন সকালে বাড়ির ও গ্রামের প্রতিবেশীরা সকলে মিলে সুবোধকে রেল স্টেশনে গিয়ে বিদায় জানিয়ে আসল । এর বেশ কিছুদিন পর জম্মুর এক অজানা সীমান্তবর্তী স্থান থেকে বাবা মায়ের কাছে সুবোধের লেখা একখানি পত্র এসে পৌছালো পত্র পড়ে জানা গেল সে ওখানে পৌছে যোগ দিয়েছে এবং সারা দিন কাজের মধ্যেই কেটে যায়, সেখানে খাওয়া দাওয়া ভালই আর যায়গাটাও তার বেশ ভাল লেগেছে। সুবোধ কাজের ফাকে সময় পেলেই মা বাবার খবর নিতেই মাঝে মাঝে পত্র লেখে এই ভাবে দেখতে দেখতে প্রায় আড়াই বছর কেটে গেল অবশ্য এরই মধ্যে সুবোধ একবার বাড়ীতে ছুটি কাটিয়ে গিয়েছিল আবার হয়ত আর একবার বাড়ীতে ছুটি কাটাবার সময় হয়ে গিয়েছে । সুবোধের মায়ের খুব ইচ্ছা ছেলেকে এবার বিয়ে দেওয়ার সেই কথা সুবোধকে পত্র মারফৎ জানিয়েওছে। সুবোধ গতবার যখন বাড়ি এসেছিল মায়ের ইচ্ছার কথা প্রাথমিক ভাবে জেনেছিল আর সে মাকে আশ্বাস দিয়েছিল বিয়ের ব্যাপারে
২
তার কোন আপত্তি নেই । সুবোধ মায়ের খুব বাধ্য ছেলে সে তার মা বাবাকে সুখে ও শান্তিতে দেখতে চায় সারাজীবন । সুবোধে বাবা মা ছেলের জন্য একটা ভাল মেয়ের সন্ধান পেয়েছে তাদের পাশের গ্রামেই তার বাড়ী । মেয়েটির সাথে তার মায়ের আলাপও হয়েছে বেশ কিছুদিন হল , মেয়েটি লাজুক ও নম্র দেখতেও বেশ সুশ্রী । ১২ ক্লাস করেছে । সুবোধের বাবা-মা ঠিক করেছে সুবোধ এবার ছুটিতে আসলে মেয়েটির সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবেন। সুবোধের বাবা মা ছেলের বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি একটু একটু করে শুরু করল। ছেলের বিয়ে বলে কথা প্রস্তুত হতে বেশ সময় তো লাগবেই। সুবোধের বাবা মা পত্রে ছেলেকে তার বিবাহের প্রস্তুতির কথা জানালো আরও জানালো এইবারে লম্বা ছুটি নিয়ে যেন আসে। সুবোধ সেই সব ভেবেই ছুটির জন্য আবেদন করল। পুজোর পরের মাসের শেষাশেষি একটা ভাল দিন পাওয়াতে দুই পক্ষ বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করে এগোতে লাগল জোর কদমে । দেখতে দেখতে পুজা এসে গেল এবং সুবোধও ছুটিতে বাড়ী ফিরে এল এর মধ্যে একদিন বাবা মা আর ছোট বোনকে সাথে নিয়ে পাশের গ্রামে মেয়ের বাড়ি গিয়ে মেয়েকে দেখে আসল ।সুবোধের খুব ভাল লাগল মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করে, মেয়েটির নাম শ্রীময়ী সেই কথা অবশ্য মায়ের চিঠিতে আগেই জেনেছিল। ওদের বিয়েও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল। আত্মীয় স্বজন গ্রামের প্রতিবেশীরা সকলেই ৩-৪ দিন খুর আনন্দ করেছে । সুবোধ ও শ্রীময়ীর আগামী দিন গুলো খুব ভালভাবে কাটতে লাগল । এরপরে একদিন সুবোধের ছুটি ফুরিয়ে এল। শ্রীময়ীকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না কিন্তু সেনাবাহিনীর চাকরী, কাজে তো যেতেই হবে । সুবোধের তিন মাসের ছুটি ফুরিয়ে গেলে একদিন সে জম্মুতে কাজের যায়গায় ফিরে গেল । ওখানে পৌছে সে তার বাবা-মা, ও শ্রীময়ীকে ভালভাবে পৌছানোর খবর জানালো। এর কয়েকদিন পর মা আর শ্রীময়ীর চিঠিতে জানতে পারল শ্রীময়ীর শরীর একটু খারাপ তবে চিন্তার কোন কারন নেই তারা চিঠিতে আরও জানিয়েছে যে নতুন অতিথি তাদের জীবনে আসতে চলেছে । পুজোর সময় সুবোধ অনেক চেষ্টা করেও বাড়ী আসতে পারল না । পুজোর ঠিক পরেই শ্রীময়ী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল । সুবোধ সেই খবর মায়ের চিঠিতে জানতে পারল কিন্তু সরকারী ভাবে এখন সমস্ত ছুটি বন্ধ করে দিয়েছে সীমান্তের অবস্থার অবনতির জন্য । সুবোধের পুত্র সন্তান আস্তে আস্তে বড় হয়ে
৩
উঠতে লাগল । সীমান্তের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গড়াতে লাগলো সুবোধের ছুটি পাওয়াও আর হয়ে উঠছিল না বাড়ীর সকলের জন্য বেশী করে ছেলেকে দেখার জন্য তার মন খুব ব্যাকুল হয়ে উঠল কিন্তু ওখানে বসে পরিস্থিতি ভাল হওয়ার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না । সুবোধ আবারও ছুটির আবেদন করে রেখেছে । এর পর আরও দুই মাস কেটে গেল সীমান্তের পরিস্থিতির কোন উন্নতি হল না এরই মধ্য এমন একটা ঘটনা ঘটল যা সুবোধের পরিবারের সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়েগেল একদিন সেনাবাহিনীর অফিস থেকে লোক এসে বাড়ীতে জানিয়ে গেল সুবোধ ৩-৪ দিন আগে এক দুর্গম স্থানে পাক সেনার সঙ্গে সীমান্ত যুদ্ধে পাক সেনার গুলিতে শহীদ হয়েছে। সুবোধ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শত্রু পক্ষের অনেককে নিহত করেছে । আনন্দের পরিবর্তে গভীর শোক সুবোধের বাড়ীতে নেমে এল তার বাড়ীতে আর গ্রামের পতিবেশীদের কান্নার আত্মর্নাদ গ্রামটাকে গ্রাস করল । এই ঘটনার দুই দিন পর সেনার লোকেরা সুবোধের মরদেহ কফিনে করে তার বাড়ীতে নিয়ে আসল তারপর সুবোধের শবদেহ শহীদের মর্যাদা দিয়ে পুর্ণ সন্মানের সঙ্গে গান সেলুট সহকারে সৎকার করা হল হঠাৎ করে দ্রুত ঘটে যাওয়া এই পরিস্থিতের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না তবুও সকলকে এই নিয়তি মেনে নিতে হবে। শিশুটি বড় হয়ে বাবার বীরত্বের কথা অনেকের কাছে থেকে শুনবে কিন্তু বাবাকে চাক্ষুস না দেখা আর বাবার স্নেহ মমতা থেকে সারা জীবন বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে ভাগ্যের এটাই পরিহাস ।
পুনশ্চ : সত্যি ঘটনার উপর আধারিত এই রচনা এবং সেই বীর সেনার জীবনকে স্মরন করে লেখা হয়েছে ।
----সমাপ্ত----
লেখক পরিচিতি
প্রবাল সেন - জন্ম দেশের রাজধানী দিল্লি ১৯৪৮ সনে। ছোটবেলা থেকে বড়ো হয়ে ওঠা এবং পড়া শোনা সবই বাঙালি পরিবেশে । চাকুরী জীবন শুরু হয় মীরাট শহরে । কর্ম উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে গমন ও থাকা । সেই সব স্থানের মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পরিভ্রমণ কে পাথেয় করে আমার সাহিত্য জগতে প্রবেশ । মূলত ভ্রমণ কাহিনী লিখলেও গল্প, জীবনী এবং স্মৃতি চারণ নিয়েও লেখালেখি করে থাকি ।
পেশা ভিন্ন হলেও নেশা আমার দেশ বিদেশ দেখা । বর্তমানে হুগলির মহকুমা শহর চন্দননগরে পাকাপাকি ভাবে থাকা হয়।
Join the conversation