জমিদার বাড়ির স্বর্ণ মুকুট রহস্য - দ্বীপ্তায়ন বিশ্বাস



  জমিদার বাড়ির স্বর্ণ মুকুট রহস্য

দ্বীপ্তায়ন বিশ্বাস


|| গোয়েন্দা গল্প||

আমার ছোটবেলার বন্ধু ঋষিকেশ মিত্র। পেশায় একজন আইনজীবী। আমি ও ঋষিকেশ দুজনে যাদবপুর বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করতাম। তবে একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় আমরা আলাদা আলাদা বিভাগ বেছে নিয়েছিলাম। আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম আর ঋষিকেশ ছিল কলা বিভাগের ছাত্র। কলা বিভাগের ছাত্র হলেও সে ছিল আমার থেকে লেখাপড়ায় যথেষ্ট দক্ষ। প্রতিভা ছিল তার বিশাল। গল্প লেখা, গান সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি বিষয় ছিল তার নখদর্পে। তারপর সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করে সেখান থেকেই আইন নিয়ে স্নাতক করে এবং আজ সে আলিপুর কোর্টের আইনজীবী। বাড়িতে বলতে তার বয়স্ক মা রয়েছে। বাবা ছিলেন একজন সামান্য অটোচালক। কিন্তু একটি বাস দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যায়। তখন ঋষিকেশের বয়স ছিল ১১ কি ১২। তারপর শুরু হয় তাদের কঠিন সংগ্রাম। তার মা লোকের বাড়ি কাজ করে ছেলেকে কষ্ট করে উকিল বানান। আজ তার সমস্ত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। খুবই অল্প বয়সে বোধ করি ২৬ কি ২৭ বছর বয়সে সে যাদবপুর অঞ্চলের সেরা আইনজীবী। ও ২ বছর কি ৩ বছরের মধ্যে অনেক সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। রবিবারের সকালে ওদের বাড়ি আমি গেলাম, প্রায় অনেকদিন পরে বলতে গেলে। ওর মা আমাদের জন্য লুচি, সাদা আলু তরকারি, রসগোল্লা বানিয়ে দিয়ে গেলেন। খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে আমরা গল্প জুড়ে দিলাম। ঋষিকেশ বলল " ভাই তোর সাথে আমার প্রায় দশ কি এগারো মাস বাদে দেখা হলো। সময়ই পাইনা একদম। বাড়িতে সন্ধ্যা হলেই মক্কেল আসে সমস্যা নিয়ে। আর তোর অধ্যাপনার কাজ কেমন চলছে অজিতেশ, শুনলাম মায়ের মুখে তুই নাকি কলেজের অধ্যাপক পদের দায়িত্ব নিয়েছিস?"
এবার আসা যাক আমার কথায়, আমার নাম অজিতেশ স্যানাল। যাদবপুর বিদ্যাপীঠ থেকে বারো ক্লাস পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে স্নাতক পাস করি ,সেখান থেকে স্নাতকোত্তর। এর মধ্যে থেকেই কলেজে নিয়োগ পরীক্ষা সেখানে পাশ করে বিদ্যাসাগর কলেজে প্রাণী বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হওয়া। 
অজিতেশ বলল" এই চলছে অধ্যাপনা। এইতো তিন মাস হলো কাজে নিযুক্ত হয়েছি। আর পাশাপাশি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছি"। ঋষিকেশ আমার এই কথা শুনে বলল"বা:বা:, এতো দারুন ব্যাপার"। চম্পারাণী মিত্র অর্থাৎ ঋষিকেশের মা বলল" অজিতেশ যখন এসেছিস তাহলে দুপুরের খাবার খেয়ে যা। আমি কাকুতি মিনতি করলাম কিন্তু ঋষিকেশ জোর করায় খেয়ে নিলাম।   দুপুরের আয়োজনও কম ছিল না। ভাত, লাল শাক, নিরামিষ মুগের ডাল, নানা রকমের ভাজা, খাসির মাংস , চাটনি, মিষ্টি এইসব। খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পর আমি ঢুকলাম ঋষিকেশ এর বাড়ির চেম্বারে যেখানে ঋষিকেশ মক্কেলের সমস্যার কথা শোনে। সেখানে একটা দেওয়াল জুড়ে সম্পূর্ণ রূপে বইয়ের সমাহার। কী বই নেই সেখানে। আমি ওর বইয়ের তাক থেকে বই নামিয়ে পড়তে লাগলাম। এমন সময় ঋষিকেশ এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। বললো " বই পড়ছিস"। আমি বললাম " হ্যাঁ"। আমি কিছু বলতে যাব এমন সময় যে আমাকে থামিয়ে  দিয়ে বলল" তোর মনে আছে আমার গোয়েন্দাগিরির কথা"। আমি বললাম "হ্যাঁ, আমার সব মনে আছে, তুই একবার ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমাদের স্কুল থেকে চুরি হয়ে যাওয়া মাইক্রোস্কোপ উদ্ধার করেছিলি, তারপর যখন ক্লাস একাদশে পড়ি তখন আমাদের স্কুল থেকে ক্লাস পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্র নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি কলেজে পড়ার সময় যখন  রাগিং কান্ড  ঘটেছিল তখন যে এর মাথা  ধরার জন্য তুই নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই সিনিয়র ছেলেটাকে ধরেছিলিস। আমার সমস্ত ঘটনা মনে আছে। এমনকি তোর দর্শন বিভাগের যিনি অধ্যাপক ছিলেন ডঃ আনন্দমোহন রায় তিনিতো তোকে বলেছিলেন যে পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে আই পি এস অফিসারের জন্য প্রস্তুতি নিতে। ঋষিকেশ বলল" ও তাহলে তোর সব কথাই মনে আছে"। এসব গল্প গুজব করে সন্ধ্যে ছটার সময় তার বাড়ি থেকে আমি রওনা হলাম। তার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি মাত্র পাঁচ মিনিট। ৫ মিনিট হলেও আমার কাজের চাপে এবং ওর কাজের চাপে দুজন দুজনের বাড়ি আসা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। দেখতে দেখতে প্রায় তিন চার মাস কেটে গেল। আকাশে  পেঁজা তুলোর মত মেঘের দেখা মিলেছে অর্থাৎ পুজো আসছে। তার মধ্যে এই খবর পেলাম আমি আমার মায়ের কাছ থেকে যে আমার মায়ের দূর সম্পর্কে আত্মীয় সম্ভবত তার খুড়ো জ্যাঠামশাই এর বাড়িতে ধুমধাম করে দুর্গাপূজা উদযাপন হয়। একথা আমি আগেও আমার মায়ের মুখে শুনেছিলাম, এমনকি যখন আমি ছোট ছিলাম তখন বাবা মার সাথে গেছিলাম সেখানে। তো মায়ের শরীর এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো না থাকার জন্য আর বাবা ব্যবসার সূত্রে এই মুহূর্তে দিল্লিতে থাকায় মা আমাকে যেতে বলল। কিন্তু মায়ের শরীরের এই অবস্থা আর আমি যাব না সেখানে। অমি তাকে বললাম " আমি যাবো না তোমাকে ছেড়ে, শরীরের এই অবস্থা আর আমি যাব দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানে, তা কখনো হয় না"। পরক্ষণে মা বলল"তুই যা রে অজিতেশ , নাহলে জ্যাঠামশাই রাগ করবেন, আর কমলিকা তো রয়েছে, আমাকে দেখাশোনা করার জন্য ও নয় আমাকে সামলে নেবে" অগত্যা আমি আর কি করি? আমি ব্যাগে জামা কাপড় গোছানোর সময় আমি ভাবলাম একা যাবো তাই ঋষিকেশ কেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তখন আমি ফোন করে বললাম তাকে এইসব ব্যাপার। তখন সে আমায় জানালো যে সে ১০ মিনিটের মধ্যেই যাবে কিনা জানাচ্ছে । ঘড়ির কাটায় যখন ঠিক দশ মিনিট হলো তখনই তার কোন কল এলো আর বলল সে যেতে রাজি। মায়ের কাছ থেকে তার দূর সম্পর্কের জ্যাঠামশাই এর বাড়ি যাওয়ার যে রাস্তা ও  ঠিকানা সবকিছু নোটবুকে আমি নোট করে নিলাম। জায়গাটার নাম হলো কুশিপুর গ্রাম । যেটা মসলন্দপুর থেকে আরো ১০ মিনিট ভেতরে। আমি সকাল পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিলাম যে ঋষিকেশ তৈরি কিনা। ও বলল যে সে তৈরি এবং আমাকে সোজা শিয়ালদা স্টেশনে যেতে বলল। আমরা দুজনে সেখানে উপনীত হলাম। ট্রেন ধরে আমরা পৌঁছলাম বিধান নগর স্টেশন। তখন ঘড়িতে বাজে সকাল সাতটা পাঁচ মিনিট। সেখান থেকে বারাসাত গামী বাস ধরে সোজা মসলন্দপুর বাসস্টপেজে নামলাম। সেখান থেকে আমরা রিকশা ধরে এলাম কুশীপুর গ্রামে । সেই গ্রামটায় প্রবেশ করার পর দেখলাম চারপাশ জুড়ে ফসলের ক্ষেত কাশফুল, শিউলি ফুল পড়ে আছে রাস্তায়। দেখে আমার আর ঋষিকেশের চোখ দুটি যেন জুড়িয়ে এলো। আমার মনে হল দেবতা যেন এই গ্রামটার উপর সমস্ত যৌবনের বৃষ্টি ঢেলে দিয়েছে। 

আমরা উপস্থিত হলাম আমার মায়ের দূরসম্পর্কের জ্যাঠামশাই এর বাড়ি। বাড়িটা প্রায় অনেকটা অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত। বাড়ির পাশে দুর্গা মন্ডপের দালান। পুজোর চার দিন আগে থেকেই দূর্গা মন্ডপের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। এমনকি প্রতিমার মুখমণ্ডল এবং অন্যান্য দেবদেবীর মুখমণ্ডলের কাজ শেষের পথে। সেখানে আমরা উপস্থিত হতে না হতেই আতিথেয়তা- আপ্যায়ন শুরু। সকালে খাওয়া-দাওয়ার বহর দেখে আমার আর ঋষিকেশের মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। খাওয়ার পর আমরা বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছি, সেই মুহূর্তে উপস্থিত হলেন এ বাড়ীর কর্তামশাই অর্থাৎ আমার মায়ের জ্যাঠা মশাই। যার নাম হলো রতনলাল মজুমদার, বয়স বোধ করি ৭৫ কি ৭৬ হবে। আমাদের দেখে বড্ড খুশি হলেন বয়স্ক ভদ্রলোকটি আমাদের সঙ্গে এবারের কিছু ঐতিহ্যশালী মুহূর্তের কথা আলোচনা করলেন। তিনি বললেন যে"আজ থেকে পঞ্চাশ- ষাট বছর আগেও এখানকার পরিবেশে একটা সাংস্কৃতিক সংস্পর্শের ঐতিহ্য বজায় ছিল, কিন্তু বর্তমানে এত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, যেসব কিছু বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। এইসব কথা আমাদের আক্ষেপের সাথে বললেন। কথা প্রসঙ্গে আমি ( অজিতেশ) বলে উঠলাম"দাদু তোমাদের বাড়িতে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে যে দুর্গাপূজা হয় সেই প্রতিমার যে স্বর্ণ মুকুট সেটা আমাদের একবার দেখাবে"। ভদ্রলোক উঠে বললেন"হ্যাঁ দেখাবো না কেন? তুই তো সেই কোন ছোটবেলায় এসেছিলিস তার নেই ঠিক, হ্যাঁ আমি তোদের দুজনকেই দেখাবো সে স্বর্ণ মুকুটটি"। আমরা উৎসাহের সঙ্গে সেই স্বর্ণ মুকুট তার কাছে গেলাম। দাদু সিন্দুক খুললেন এবং বের করলেন সেই স্বর্ণ মুকুটটি। আমি ও ঋষিকেশ সেই স্বর্ণ মুকুটের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না এতটাই উজ্জ্বল্যপূর্ণ সেই স্বর্ণ মুকুট টা। আমরা সেই স্বর্ণ মুকুটটি দেখার পর দাদু অর্থাৎ রতনলাল মজুমদার সেটি সিন্দুকের মধ্যে রেখে দিলেন। দাদুর সাথে আমি বেরোবো এমন সময় দেখি ঋষি ওই ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম"কিরে ওদিকে কি দেখছিস? কেউ কি আছে ওদিকে"? ওর সঙ্গে সঙ্গে বলল"আমাদের কথায় কে যেন আড়ি পাত ছিল"। আমি বললাম" কেউ তো নেই সেখানে "। এই কথাগুলো বলে আমি আর ঋষিকেশের ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। দুপুরের খাবারের তালিকায় ক্রম আয়োজন ছিল না। খাবারের তালিকায় কি নেই? সারা ধবধবে বাসমতি চালের ভাত, লাল শাক, সবজি, নিরামিষ ডাল, আলুর পোস্ত, পাবদা মাছের ঝাল, মুড়ি ঘন্ট, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, খাসির মাংস, আনারসের চাটনি, মিষ্টি পাপড় এইসব। খেয়েদেয়ে পরিবারের সবার সাথে একটু গল্প করার পর আমি ও ঋষিকেশ ভাতঘুম দিলাম।। আমায় ঋষিকেশ বলল"তোর মায়ের জ্যাঠামশাই এর বাড়ির সদস্যগণ খুবই ভালো এবং অতিথি পরায়ন। আর তোর মেজো মামি খুবই অতিথির আতিথেয়তা করেন। এইসব গল্প করতে করতে আমি আর ঋষিকেশ কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমার আর খেয়াল নেই। আমার ঘুম ভাঙলো মশার কামড় খেয়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘড়িতে বিকেল চারটে বাজতে পনেরো। ঋষিকেশ দেখি ঘরের মধ্যে নেই। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি ও পাশের লাইব্রেরী ঘর থেকে বই নামিয়ে বই পড়ছে। আমি চোখ ডলতে ডলতে এসে বললাম"ও তুই এই ঘরে বসে বই পড়ছিস"। ঋষিকেশ আমায় তখন বলল"হ্যাঁ"। তখন আমি বলে উঠলাম" কি যে এত বই পড়িস..... আরো কিছু বলতে যাব, ও বলে উঠলো"বই হল আমার কাছে সমস্ত জ্ঞানের উৎস। এটা ছাড়া আমার কাছে জীবন সম্পূর্ণ বৃথা"। আমি আর কিছু না বলে বেরিয়ে আসলাম ঘর থেকে। গ্রামের দিকে সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরি করে না। আর এবারের একটা রেওয়াজ দেখে বড় ভালো লাগলো যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এ বাড়ীর কর্তা মশাই রতন লাল মজুমদার ওরফে আমার মায়ের জ্যাঠামশাই ব্রাহ্মণের বেশে গীতা পাঠ করেন। বাড়ির সদস্য ও গ্রামের পুরুষ মহিলা সকলে একত্রে গীতার পাঠ পরিবেশন শুনতে আসেন। গীতার পাঠ হয়ে যাওয়ার পর বাড়ির সদস্যরা মিলে রীতিমতো গল্প বৈঠকের আসর জমিয়ে দিল। এমন সময় এ বাড়ীর বড় ছেলের ফোন এলো এবং তাকে যেতে হল শহরের দিকে। ঠিক সেই সময় ঋষিকেশের ও ফোন এলো। ঋষিকেশ ও ঠিক সেই সময় বেরলো, তখন আমি তাকে বললাম যে আমাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু সে আমায় তার সঙ্গে নিল না। সে একা বেরিয়ে গেল কাজ ছেড়ে ঋষিকেশ সবার আগে ঘরে ঢুকলো কিন্তু বড় মামা অর্থাৎ বাড়ি বড় ছেলে একটু দেরি করে বাড়ি ঢুকল। তারপর আমরা রাত্রিকালীন খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। এ বাড়ির নিয়ম যে সকাল চারটের ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজ পড়লে ঘুমিয়ে থাকা যায়না। কিন্তু ঘুম ভাঙলো আমার মেজো মামীর চিৎকারের আওয়াজ শুনে। বাড়ির সবাই, ঋষিকেশ, আমি আর দাদু সেখানে ছুটে গেলাম। আমার মেজ মামা মামিকে জিজ্ঞেস করলেন" কি হলো? তুমি চিৎকার করলে। মেজ মামি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন"সর্বনাশ কান্ড হয়ে গেছে। আলমারির চাবি খোলা আর দুর্গা মায়ের স্বর্ন মুকুট সেখান থেকে উধাও। বাড়ির সদস্যদের চোখ কপালে, দাদুর তো মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার জো। আর ও কত কান্ড। সেই সময় আমার ছোট মামা পুলিশে ফোন করলেন আর আধ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ ইন্সপেক্টর ও দুজন পুলিশ কনস্টেবল এল। বাড়ি খানা তল্লাশি হল কিন্তু যে অপরাধী সে কোন চুরির ছাপ রেখে যায়নি। বাড়ির সদস্যদের পরিচয় নেওয়া হলো, এমনকি আমাদেরও পরিচয় নেওয়া হলো। তাদের মধ্যে দেখি যে একজন পুলিশ কনস্টেবল আমাদের চেনা। ঋষিকেশ বলল" আরে বিমল যে, কেমন আছিস বল"। সেও কিছুক্ষণ বাদে বলল"তুই ঋষিকেশ না। তুইতো দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলি না। আর তুই অজিতেশ তাইতো, তোর ডিপার্টমেন্ট ছিল জুলজি না। চিনতে পেরেছি এবার। 
এবার আসি বিমলের পরিচয়। ওর নাম বিমল নাথ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ স্নাতক এবং সেখান থেকেই স্নাতকোত্তর। স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পর পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় বসে পুলিশে চাকরি। আর এখানকার স্থানীয় থানার কনস্টেবল। এই বিষন্নতার মাঝে আমরা গল্প জুড়ে দিয়েছি। বিমল তখন আমাদের বলল"ঋষিকেশ, তোর মত ছেলে এখানে আছে তো তদন্ত তো একদিনে মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা"। তুই, আমি এবং সোমনাথ লাহিড়ী (পুলিশ অফিসার) বাবু এখানে আছি তো তাহলে আমরা এই তদন্ত একসাথে করতাম। তাহলে সুবিধা হত এই আর কি। কারণ তোর তদন্ত করার স্টাইল সম্পূর্ণ আলাদা। ঋষিকেশ বলল"এরকম হয় না। একটা জায়গায় এসেছি একজন অতিথি ব হয়ে সেখানে বহন তো শুরু করে দেব তা আবার হয় নাকি? বিমল বলল"তুই ভেবে দেখ না"। ঋষিকেশ কে আমিও বললাম"তুই তদন্তের কাজ কর, আমরা তোর পাশে আছি"। তখন ও আর না করল না। বলল"ঠিক আছে"। পুলিশ কনস্টেবল বিমল নাথ ইন্সপেক্টর সোমনাথ বাবুর কাছে গিয়ে ঋষিকেশের গোয়েন্দাগিরির কথাটা পারলো। তখন সোমনাথ বাবু বললেন"ওর নাম পরিচয় না জেনে আমি ওকে এই কেসের তদন্তের ভার কিভাবে দিই"? বিমল তখন ওর পরিচয় দিল-"ওর নাম  ঋষিকেশ মিত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করে, আইন নিয়ে স্নাতক করে যাদবপুর অঞ্চলের সেরা আইনজীবী। আর আমি ছিলাম ওই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। আমরা পড়াশোনা করাকালীন ও কলেজে দু-দুটো তদন্তের কাজ করেছিল। তাই আমি চাইছি ও কিছুটা সাহায্য আমাদের করুক। পুলিশ অফিসার সোমনাথ বাবু বললেন"যা বোঝো কর। আমি তোমাদের সাথে আছি। আর তোমাদের বয়স অল্প কোনো কাজ খুবই দ্রুততার সঙ্গে করতে পারবে"। বাড়ির সবাই ঋষিকেশ কে সম্মতি প্রদান করল। কিন্তু দাদু তাকে একটা শর্ত দিলেন যে ষষ্ঠীর বোধন হওয়ার আগেই যেন তারা তাদের সেই মুকুটটা ফিরিয়ে দেয়। ঋষিকেশ, বিমল, আমি, এবং অন্য একজন পুলিশ কনস্টেবল অমিত এই স্বর্ণ মুকুট উদ্ধার রহস্যে লেগে পরলাম।  ঋষিকেশের সহকারী হিসেবে আমিও তাকে সাহায্য করলাম এই মুকুট উদ্ধারের জন্য। আমি একটা জিনিস দেখলাম যে ঋষিকেশ বাড়ির সবার পরিচয় নিচ্ছে। সে একটা তালিকা তৈরি করল আর তা এমন দাঁড়ালো যে, রতনলাল মজুমদার এর তিন ছেলের তিন স্ত্রী। যেমন-

১. আকাশ কুমার মজুমদার-বাড়ির বড় ছেলে। বয়স- ৫১ বছর। কলকাতার এক রিয়েল এস্টেট দপ্তরে কাজ করে। 
২. মধুমালা মজুমদার- বাড়ির বড় ছেলের স্ত্রী। বয়স - ৫০ বছর। 

৩. নীলাভ মজুমদার- বাড়ির মেজো ছেলে। বয়স- ৪৫ বছর। গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষকতা  করেন।
৪. নয়না মজুমদার- মেজো ছেলের স্ত্রী। বয়স- ৪৪ বছর।
৫. অরিত্র মজুমদার- বাড়ির ছোট ছেলে। বয়স- ৩৫ বছর। পেশায় একজন কলকাতার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
৬. সুমিতা মজুমদার-ছোট ছেলের স্ত্রী। বয়স- ৩১। 
৭. শ্যামাপ্রসাদ লাহা-এ বাড়ীর চাকর। বয়স- ৪৮। বাড়ির কাজ মূলত করে থাকে সে।
৮. এছাড়া বাড়ির রান্নার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন মহিলা ও পুরুষের পরিচয় সে নিল। 


  এই তালিকা নিয়ে ঋষিকেশ কি যেন আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো। অমনি বলে উঠলো "আপনাদের বাড়ির যে চাকর শ্যামাপ্রসাদ তাকে যে দেখছি না, সে কোথায়"? রতন লালের বড় ছেলে আমতা আমতা স্বরে বলল"সে কিছুদিনের জন্য  দেশের বাড়ি গেছে"। কথা শুনে ঋষিকেশ বলল"ও"। পুজো শুরু হতে ঠিক তার দুদিন বাকি, বাড়ির সদস্যগন দের চিন্তায় ঘুম উড়েছে। তদন্তর কাজও চলছে। তখন বিমল ঋষিকেশ কে বলে উঠলো"দেখ ভাই কেস টা বন্ধ করে দিই, কারন আমরা তো এর কোন হদিস পাচ্ছিনা"। ঋষিকেশ তার কথা এক কান দিয়ে ঢোকালো আর অন্য কান দিয়ে বের করল। ঋষিকেশের তদন্ত যেন শার্লক হোমস, ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলু মিত্তির, কিরীটি রায়, দারোগা প্রিয়নাথ কে ছাপিয়ে যাবে। এই কথাগুলো বলব এখন তাই আমি তৈরি হচ্ছি এমন সময় সে বলল"পেয়েছি, পেয়েছি পালের গোদাটা কে তা আমি এবার বুঝতে পেরেছি"। আমি আর বিমল  অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে  তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম" ব্যক্তিটা আসলে কে"? ঋষিকেশ বলল"এর মধ্যে দুজনের উপস্থিতি রয়েছে এটা আমি বুঝতে পেরেছি"। ঋষিকেশ এই কথাগুলো বলে দালানে বাড়ির প্রত্যেক সদস্যদের আসতে বলল। দাঁড়ানো সবাই উপস্থিত হলেন। সবার মুখে আনন্দের আভাস পাওয়া গেলেও বাড়ির চাকর শ্যামাপ্রসাদ এর মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। ঋষিকেশ বলল"শ্যামাপ্রসাদ এবার তুমি বলো, তুমি কার কথায় এমন জঘন্যতম কাজটি করেছো?  ঋষিকেশের মুখে এই কথা শুনে সবার চোখ কপালে উঠে গেছে। জমিদার বাড়ির কর্তা স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ কে প্রশ্ন করলেন"আমি ভাবতেও পারছি না তুমি এটা করবে"। তখন শ্যামাপ্রসাদ কাঁদো কাঁদো মুখে ঋষিকেশকে উদ্দেশ্য করে বলল"আমাকে বড় কর্তা বাবু করতে বলেছেন তাই আমি এই কাজটি করেছিলাম। ঋষিকেশ বলল"আকাশ বাবু আপনি এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমি তখনই ধরতে পেরেছিলাম। বাড়ির সদস্যগনরা এই কথা শুনে চমকে উঠলেন। তখন বাড়ির বড় ছেলে আকাশ কুমার মজুমদার বললেন"আমি কিছুই করিনি, আর যদি আমি কিছু করে থাকতাম তাহলে এখানে আমি দাঁড়িয়ে বড় বড় কথা বলতাম না। আর তুমি ঋষিকেশ নিজেকে খুব বড় গোয়েন্দা ভেবোনা। সামান্য দুদিনের উকিল তুমি কি বোঝো এসব ব্যাপার, তাহলে ওকালতি ছেড়ে গোয়েন্দাগিরির কাজে লেগে যাও তোমার জন্য ওটাই সবথেকে সহজ সুলভ কাজ হবে। বটতলার উকিল কোথাকার"। এইসব কথাগুলো ঋষিকেশের কানে বাধলে ও সে নিজেকে শান্ত ভাবে বজায় রাখল। ঋষিকেশ তখন বলল"আমি যখন পাশের ঘরের লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ছিলাম তখন আমি আপনাদের সব কথা গুলো রেকর্ড করছিলাম। এমনকি যখন আপনি পরশুদিন রাত্রিবেলা বেরোলেন তখন আমি আপনার পিছু নিয়েছিলাম ,আপনি কোথায় গিয়েছিলেন সেটাও আমি জানি। সেই মুহূর্তে কাঁদো কাঁদো স্বরে বাড়ির বড় ছেলে বলল"তুমি কি করে জানলে আমি কোথায় গিয়েছিলাম"? ঋষিকেশ সেই মুহূর্তে বলে উঠলো"আপনি গিয়েছিলেন সোনার দোকানে। যে সিন্দুকে স্বর্ণ মুকুট টা থাকে সেই তালার নকল চাবি বানাতে, আপনি সেই নকল চাবিটা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু সেটা খোলার পর শ্যামাপ্রসাদ আপনাদের বাগানে ফেলে রেখে চলে যায়। আর আমি ঠিক সেই সময় সেই চাবিটা বাগান কুড়িয়ে  নিজের পকেটে রাখি। আমি চাইলে সেই মুহূর্তেই আপনাকে ও শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে ধরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু তাতে কোন লাভ হতো না কেননা আমি একজন আইনের লোক তো আইনের লোক সর্বদা আইনেরই সাহায্য নেবে। তো সেই জন্য এই দায়িত্ব পুলিশের হাতেই অর্পণ করা হোক সেটা আমি চেয়েছিলাম। এমনকি আপনার মেজ ভাই ও এই ব্যাপারটাও জানতেন। তাই আমি তাকে সবকিছু খোলসা করে বলি এবং তিনি পুলিশ ডাকলেন সেই মুহূর্তে"। এইসব কথাগুলো শুনে বাড়ির বড় ছেলে আকাশ কুমার মজুমদার  লজ্জার স্বরে বলল" হ্যাঁ, আমি চুরি করতে বলেছিলাম শ্যামাপ্রসাদ কে কারণ আমাদের রিয়েল এস্টেট ম্যানেজার বলেছেন যে যদি আমি তাকে আমাদের বাড়ির ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে থাকা স্বর্ণ মুকুট টা না দিলে তাহলে আমাকে সে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। তাই আমি এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম"। ঋষিকেশ বলল"এই মুহূর্তে সেই স্বর্ণ মুকুট টা তাহলে কোথায় রেখেছেন"? তখন বড় ছেলে বলল"হ্যাঁ ঋষিকেশ আমি তোমার সেই স্বর্ণ মুকুট টা এনে দিচ্ছি"। তখন বড় ছেলে তার স্ত্রীকে আদেশ দিলেন যে স্বর্ণ মুকুট টা নিয়ে আসতে। এবং তার স্ত্রী মধুমালা দেবী সেই স্বর্ণ মুকুটটি নিয়ে এলেন এবং জমিদার বাড়ির বড় কর্তা রতন লাল মজুমদারের হাতে অর্পণ করলেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর সহ একজন কনস্টেবল সেই মুহূর্তে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করলেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর সোমনাথ লাহিড়ী ঋষিকেশ কে বললেন"অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার মত ছেলে যদি আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে থাকতো তাহলে একেবারে তাকে সোনা দিয়ে মুড়ে রাখতাম"। এইসব কথাগুলো বলে ইন্সপেক্টর বাবু বললেন"এখনই আপনাদের গ্রেপ্তার আমি করলাম না, আগে এই বাড়ির পুজো মিটুক তারপরে এটি মীমাংসা করা যাবে"। এই বলে তিনি, বিমল সহ পুলিশ কনস্টেবলরা সেখান থেকে বিদায় নিলেন। আমি আর ঋষিকেশ খুবই আনন্দের সঙ্গে গ্রামের পুজো কাটালাম। পুজো শেষ হয়ে গেলে সেখানকার স্থানীয় আদালতে ঋষিকেশ মিত্র জমিদার বাড়ির হয়ে মামলা লড়লো ও মামলায় জিতে গেল। আদালতে জজ সাহেব বললেন চাকর শ্যামাপ্রসাদ এর চুরির করার দায়ে এক বছরের জেল এবং জমিদার বাড়ির বড় ছেলে আকাশ কুমার মজুমদার বাবুর পাঁচ বছরের জেল হেফাজত হলো। এছাড়া রিয়েল এস্টেট এর ম্যানেজার প্রতাপ কুমার সিংহের ১০ বছর জেল সহ দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হলো। এই কেসের মীমাংসা হওয়ার পর ঋষিকেশ কুড়ি হাজার টাকা লাভ করল। এবং আমি আর ঋষিকেশ জমিদার বাড়ির বড়কর্তামশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যের পথে রওনা হলাম।। পথে যেতে যেতে আমি ঋষিকেশকে বললাম"তুই সব জানা সত্ত্বেও আমাকে অথবা বিমলকে জানালি না কেন? তখন ঋষিকেশ বলল"যদি আমি সবার কাছে এই খবরটা খোলসা করে দিতাম তবে এই কেসের বা তদন্তের কোন দিক থাকত না" ।

----সমাপ্ত----

 

লেখক পরিচিতি

লেখক পরিচিতি - দ্বীপ্তায়ন বিশ্বাস ২০০৬ সালে ২৫ অক্টোবর উত্তর ২৪ পরগনা জেলার জগদ্দল অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বিজয় কুমার বিশ্বাস। পেশায় একজন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী।  মাতার নাম মঞ্জুলা বিশ্বাস। একজন গৃহকর্মী। বাড়িতে তার দাদা ও বৌদি আছে। তিনি ২০১৬ সালে সুন্দিয়াপাড়া নিবেদিতা বাস্তুহারা বিদ্যামন্দির থেকে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন। ২০১৭ সালে তিনি ভাটপাড়া অমরকৃষ্ণ পাঠশালায়  ভর্তি হন। ২০২৩ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন এবং সেই স্কুলে কলা বিভাগের ছাত্র। তার লেখালিখি শুরু ২০২২ সাল থেকে। তার লেখা ' মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষনায় ভারতের আত্মনির্ভরতা ' নামক নিবন্ধ ভাটপাড়া অমরকৃষ্ণ পাঠশালার ' স্বারস্বত' নামক বার্ষিক স্কুল পত্রিকায় ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয় ও পদাতিক পত্রিকায় ' হিমালয়ের কোলে ' নামক নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তিনি একজন ছাত্র।