ধুলো - রাজকুমার দাস

 


     ধুলো 

                           রাজকুমার দাস 


                   

                                                        


আজ সকাল থেকে, আকাশে অবস্থা খুব খারাপ, কালো মেঘের বিচরণ, জোরে জোরে বাতাস বইছে, এই যেন বৃষ্টি এলো বলে। তবে সবকিছুইকেই উপেক্ষা করে, প্রতিদিনের মতো অজয় নগর রাজ্যে আজ রাজসভা বসেছে। সকল সভাসদ উপস্থিত— সভাকবি তরূদত্ত ছাড়া।
আজ বৃষ্টি তাই সভা চললেও সভার কাজ বন্ধ। সবাই খোশমেজাজে আড্ডা-গল্পে ব্যস্ত। পাকশালা থেকে নানাবিধ উৎকৃষ্ট খাবার-দাবার নিয়ে আসার আদেশ দিলেন রাজা মশাই। ইতিমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
রাজামশাই রাজ সিংহাসনে বসে, সভাকবির জন্য অপেক্ষা করছেন। সভাকবি রাজার খুব প্রিয়, অনেক সময় রাজাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন।
রাজামশাই: কী হলো বলতো মন্ত্রী, সভাকবি তো এতো দেরি করে না কোনো দিন।
মন্ত্রী: হুজুর, আপনি তো ওকে কিছু বলেন নাই, তাই হয়তো, বাড়িতে খেয়ে দেয়ে ঘুম দিচ্ছে।
রাজামশাই: না, না, মন্ত্রী, সভাকবি তো এই রকম করতে পারে না।
সভাসদ: (সভাসদদের কিছু জন বলে উঠলো) ও সব করতে পারে হুজুর, তলে তলে খুব বদমাশ।
অর্থমন্ত্রী: হুজুর, মন্ত্রী মশাই ঠিক বলেছেন।
রাজা সুবর্ণ রেগে গিয়ে প্রহরীকে বলে উঠলেন,
প্রহরী, গিয়ে দেখ্, সভাকবি কোথায়? আর ও যদি বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকে তাহলে ওকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে, আসবি আজকে ওর খবর আছে।
প্রহরী নতমস্তকে সেই ভারী বৃষ্টিতে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে, বলল,
হুজুর, সভাকবি বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বেরিয়েছেন, আমার কথা শুনে তো কবি পত্নী খুব চিন্তা করছেন।
রাজামশাই: তাহলে কোথায় গেল সভাকবি, কিছু বিপদ হলো না তো।
মন্ত্রী: (বিড়বিড় করে) কিছু হলে তো বাঁচি।
রাজামশাই: কিছু বললে মন্ত্রী?
মন্ত্রী: না, রাজামশাই।
ঠিক সেই সময়, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সভাকবি উপস্থিত।
রাজামশাই বলে উঠলেন, "যাও আগে ভিজে পোশাকটা ছেড়ে আস, তারপর তোমার খবর আছে।"
পোশাক পরিবর্তন করে, সভাকবি সভার আসনে বসতে বসতে বলে উঠলেন, "আজ এতো বৃষ্টিতেও, রাজামশাই, এতো বড় রাজমহলে এতো ধুলো! আমার পুরো পায়ে ধুলো লেগে গেল।"
রাজামশাই: "কী বল কবি, আমার রাজপ্রাসাদে এতো ধুলো!"
মন্ত্রী: "কার বাড়িতে ধুলো থাকে না? সবার বাড়িতেই থাকে।"
রাজা: "কবি, তোমার বাড়িতে ধুলো নেই নাকি?"
কবি: "হুজুর, আমার বাড়ি তো মাটির বাড়ি, আমার তো ধুলো থাকবে। হতে পারে মন্ত্রী মশাইর বাড়িতে নেই।"
মন্ত্রী: "না, হুজুর, আমার বাড়িতেও ধুলো আছে।"
রাজামশাই চুপ করে কিছুক্ষণ থাকার পর বললেন, "যদি এই বৃষ্টিতে তার বাড়িতে ধুলো নেই, তাকে আমি পুরস্কৃত করবো।"
কবি: রাজামশাই, আপনি যদি আদেশ করেন, আমি কিছু জনকে নিয়ে এসেছি, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের বাড়িতে এই বৃষ্টিতে কোনো ধুলো নেই।
রাজামশাই: (বুঝতে পারলেন সভাকবি আবার কিছু করতে চলেছেন।) তাই বলে উঠলেন,
দোখো সভাকবি, নিয়ে আসতে পারো ওদের,
যদি প্রমাণ করতে না পারো, তাহলে গর্দান যাবে।
মন্ত্রীমশাই: (মনে মনে খুব খুশি হলেন। মনে ভাবছেন, বৃষ্টি হোক রোদ হোক, সবার বাড়িতেই ধুলো থাকে। মনে মনে হাঁসতে লাগলেন কবির বোকামির জন্য।)
কবির ডাকে একসাথে পনেরো-কুড়ি জন, সামান্য ছিঁড়ে যাওয়া পোশাক পরা কয়েকজন প্রজা রাজসভায় ঢুকে, নতজানু হয়ে বলে উঠলেন,
হুজুর, আমাদের কারুর বাড়িতে ধুলো নাই। আপনি চাইলে দেখে আসতে পারেন।
রাজামশাই মনে মনে খুব হাঁসলেন কবির বোকামির জন্য।
রাজামশাই: কী বলছো তোমারা? আমার এতো বড় রাজপ্রাসাদ, এতো জন কাজ করে, তারপরও ধুলো আছে। আর তোমাদের বাড়িতে নাই? ভেবে বলছো তো? না হলে তোমাদের গর্দান যাবে, সাথে সভাকবিরও।
প্রজা: হুজুর, ঠিক বলছি। যদি ভুল হয়, তাহলে যা সাজা দেবেন মাথা পেতে নেব।
কবি: হুজুর, তাহলে রওনা হওয়া যাক।
রাজামশাই: চলো সবাই।
মন্ত্রীমশাই: চলুন হুজুর (হাঁসতে হাঁসতে)।
রাজামশাই, কবি, সভাসদ সমেত সবাই উপস্থিত হলেন রাজ্যের দক্ষিণে কুমোরদের পাড়ায়।
রাজামশাই পালকি থেকে নামতেই তার সর্বাঙ্গ শরীর থেকে নিজের উপর ঘৃণা হতে লাগলো। তার চোখ দিয়ে অশ্রু পড়তে লাগলো। পড়বেই তো, তার চোখের সামনে নারী, পুরুষ, বাচ্চারা এই বৃষ্টিতে ভিজছে, বাচ্চারা কাঁপছে ঠান্ডায়। বাতাসে ছোটো ঘরগুলোর ছাউনী উড়ে গেছে, কিন্তু তার রাজত্বে প্রজাদের এরূপ করুন অবস্থা।
কিন্তু এদের তো এক বছর আগে বাড়ি তৈরির টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে।
কবি: কী বলেন হুজুর, ধুলো কী দেখতে পাচ্ছেন? দেখুন চারিদিকে শুধু কাদা আর কাদা, কোনো ধুলো নেই।
রাজামশাই অর্থমন্ত্রীর দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, "এতোগুলো টাকা কোথায় গেল?"
অর্থমন্ত্রী কাঁচুমাচু হয়ে বলে উঠলেন, "মন্ত্রীমশাই জানেন আমি কিছু জানি না।"
মন্ত্রীমশাই বললেন, "মহারাজ ক্ষমা করে দেন, এই ভুল আর হবে না কোনো দিন।"
রাজামশাই বললেন, "তোমার গর্দান যাবে!"
মন্ত্রী বললেন, "হুজুর আমি একা সব টাকা রাখিনি, সিপাহী আর অর্থমন্ত্রীও সমান ভাগ নিয়েছেন।"
রাজামশাই বললেন, "সব কয়টার গর্দান যাবে! প্রহরী, এদের কোমরে দড়ি বাঁধো, আর কারাগারে নিক্ষেপ করো।"
রাজামশাই কবির উপর আনন্দিত হয়ে মুক্তার মালাটি গলায় পরিয়ে দিলেন, কবিরকে প্রজাদের ঘরগুলো তৈরি করার দায়িত্ব অর্পণ করলেন।
প্রজারা রাজ্যের, রাজামশাই, কবির নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগলো।

----সমাপ্ত----

                       লেখক পরিচিতি

নাম: রাজকুমার দাস

জন্মস্থান ও তারিখ: [ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেলদা থানার অন্তর্গত বিম্বলটিটিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

জন্ম:22 নভেম্বর 1998 সালে।]

শিক্ষা: [গনিতের অনার্স বিভাগে শিক্ষারত। 

পেশা: [পেশায় গনিত বিষয়ে গৃহশিক্ষক, এবং সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত আমিন সার্ভেয়ার,  ]

লেখালেখির ধরণ: [কবিতা, ছোটোগল্প দিয়ে 2024 সালে সাহিত্য জগতে পদার্পণ ]

প্রকাশিত কবিতা [1.প্রাক্তন প্রেমিকা 2.অপেক্ষা 3.পাহাড়ি কন্যা 4.জাতিস্মর (প্রথম প্রকাশিত) 5.প্রকৃতি আমার প্রেমিকা 6. ডাকো একটি বার ..ইত্যাদি] 

প্রকাশিত গল্প: [1.সেই তো গেল আর ফিরলো না 2.সাহায্যের হাত  ইত্যাদি] 

প্রকাশিত নাটক : ধুলো ।

অর্জন ও পুরস্কার: [বহু  প্রকাশনী থেকে  সম্মানিত ও পুরষ্কৃত ]