হারিয়ে যাওয়া - ডঃ রীনা বসু মুখার্জি

     


পটভূমি ত্রিপুরার পিলক।যে অঞ্চলে প্রত্নতাত্বিক খননের ফলস্বরূপ বহু ছোট বড় মূর্তি, মন্দিরের অংশ মূলতঃ তিনটি অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। অবশ্যই আরকিওলজিক্যাল সার্ভে সব কটি জায়গার ই তত্বাবধায়ক।তারা সব জায়গায় পাহারাদার রেখেছে,সুন্দরভাবে ঘিরে দিয়েছে সেই অঞ্চলগুলো। পর্যটকরা আসে শীতেই বেশীরভাগ,তারা যাতে ভালভাবে ঘুরে দেখতে পারে।সবচাইতে বড় জায়গাটাতে আছে মিউজিয়াম। কিছু প্রন্ততাত্বিক  বিশাল মূর্তি বিশাল টিন দিয়ে ঢাকা।
             এই মিউজিয়ামের একজন গার্ড সুকোমল তরফদার। খুব চটপটে,চোখে মুখে কথার খই ফোটে।বয়স আর কত হবে , এই বছর  বাইশ।পর্যটকরা খুব পছন্দ করে,একটা দল তো মন্তব্যের খাতায় তার নাম উল্লেখ করে প্রশংসা করেছে।
               এমন মানুষের বন্ধুর সংখ্যা কম নয়।তার বাড়ি ঘর আগরতলার কাছেই এক ছোট পাড়ায়।সেখানে এখনো চা এর বাগান আছে।কিন্ত তার আসল বাড়ি বরিশাল, বাংলাদেশে।
বেশি দূর নয়,কিন্তু এখানে ও কোয়ার্টার পেয়েছে।আসলে খুবই করিত্কর্মা সে।কাছের গ্রামের অল্পবয়সী মেয়েরাও প্রায়ই এদিকে আসে স্কুল থেকে,কখনো বিকেলে বেড়াতে।বেশ একটা ঘুরে বেড়াবার জায়গা তাদের। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া।

বছর সতেরোর ইলেভেনে পড়া মৌমিতাও আসে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলের পর। তাদের এই পিলক জায়গাটা প্রায় সমতল,তাই চাষজমি চারিদিকে।মাঝে বেশ বড় কয়েকটি ঘিরে দেওয়া জায়গা, যেখানে 
প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভার সাজানো।বসতি ও স্কুল, বাজার দোকান  পিলকের অন্য দিকে। মৌমিতা, অঞ্জনা,সুমনা,স্নিগ্ধা যখন এই প্রায় নির্জন জায়গায় আসত,তখন অনুপমের আলাপ জমাতে অসুবিধে হত না।তবে তার টার্গেট ছিল কটা চোখ ফর্সা মৌমিতার দিকে।গল্প তো হত ই, সঙ্গে মৌমিতার গান।শেষে জানা গেল অনুপমের বাড়িও গানের বাড়ি।সে ভালো নজরুলগীতি ও পল্লীগীতি গাইতে পারে।আর মৌমিতার আধুনিক ও রবীন্দ্র, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের ভালো চর্চা আছে।সে গান শেখেও,তার বাড়ি বেশ সম্পন্ন গৃহস্হ পরিবার।তার একটি ভাই আছে। ক্লাস নাইনে পড়ে,তারা দুজনেই পড়াশোনায় ভালো।ভাই ফুটবলে চৌখশ,অবাক লাগে দুজনের খেলাধুলা,ললিতকলার ব্যুৎপত্তি দেখে।
             যাই হোক,অনুপম মৌমিতার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে প্রেম,তার থেকে গভীর প্রেমে পর্যবসিত হল। অল্প সল্প শারীরিক ঘনিষ্ঠতা শুরু হল।একে অপরকে ছেড়ে থাকা দুষ্কর হল তাদের। ঠিক হল তারা বাড়ির অমতে বিয়ে করব।তারা অল্প বয়সের দুর্দম শরীরের টান উপেক্ষা করতে পারল না। অনুপমের ইচ্ছা ছিল কাছাকাছি কোনো হোটেলে মৌমিতাকে ভোগ করবে।মৌ একেবারে বেঁকে বসেছিল।ইচ্ছে ছিল তাদের দুজনের সম্পর্কটা শুধু শরীরের আবর্তে ঘোরাফেরা করবে।যাই হোক, মৌমিতার বাড়িতে মা প্রথম টের পেল, কিন্তু মেয়েকে বুঝিয়ে, শারীরিক নির্যাতনেও কিছু ফল হল না। ঘরে বন্ধ করে রাখা হল তাকে,পাহারা দিয়ে বাথরুমে আর ঘরেই ওর মা খাবার দিয়ে যেত । কিন্তু ভুল করে একেবারে প্রথমে মৌমিতার মোবাইল ওর থেকে নিতে ভুলে গিয়েছিল ওর বাবা মা।অতএব বাথরুমের জানালার আগল সরিয়ে বর্ষাণমুখর সন্ধ্যায় এক বৃহস্পতিবারে সে পালিয়ে গেল তাদের একতলা বাড়ি থেকে।আর নির্জন এক জায়গায় অপেক্ষায় ছিল অনুপম।ওর বন্ধু গাড়ি নিয়ে তৈরি ছিল। খুব তাড়াতাড়ি তারা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির চত্বরে পৌঁছে গেল।কারণ পিলক থেকে মন্দির চত্বর কাছেই।সে রাত্রে তারা একটা হোটেলে উঠল।

বিয়ে হয়ে যাওয়াতে সহজ সরল মৌমিতা নিজেকে অনুপমের হাতে সমর্পন করে দিল।দুটো দিন হোটেলে কাটিয়ে তারা দুজন আগরতলা এলো গাড়িতে।ওখান থেকে আখাউড়া সীমান্ত কাছেই।সহজেই ওখান থেকে বাংলাদেশ পৌঁছন যায়।অতএব, খুব তাড়াতাড়ি তারা ঢাকার কাছাকাছি গ্রামে এক পরিচিত র বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিল।সেই লোকটি মানে ফণি সমাদ্দারের একটা ব্যবসা ছিল 'মেয়ে পাচারের। সেজন্যই আগে থেকে মোবাইলে অনুপম সব ঠিক করে রেখেছিল। কম বয়সী মৌমিতাকে বেচে সে ভালো টাকা রোজগার করতে পারবে। এজন্যই ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে ঘটনাটা। ঘটানো।পিলকে মৌমিতার পরিবারের তাদের খুঁজে পাওয়া প্রায় দুষ্কর।কারণ,বুদ্ধিমান অনুপম নিজের কাজের জায়গায় চার দিনের ছুটি নিয়েছে।জানিয়ে গেছে আগরতলায় তার বন্ধুর দিদির বিয়েতে যাচ্ছে। সেখানে সত্যিই তার বন্ধুর দিদির বিয়ে ছিল।ক্ররবুদ্ধি অনুপম সেভাবেই নাটক সাজিয়ে গিয়েছিল,তাতে সে পাশ কাটিয়ে নির্দোষ থাকতে পারে।কিন্ত শেষরক্ষা হলনা।মৌ এর পরিবার তার পালাবার খবর পাবার পর ই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো ফাঁকফোকর না রেখে অনুপমের থাকবার জায়গাটা খুঁজে বার করে ফেলে বাংলাদেশের পুলিশের সাহায্যে।
            একেবারে শেষ মুহূর্তে মৌ কে পাওয়া যায় বিধ্বস্ত অবস্হায়।তাকে ত্রিপুরায় ফিরিয়ে আনা হয়।আর তার পরিবার তাকে ফিরিয়ে নিতে খুব ই আগ্রহী ছিল। লোকলজ্জার ভয় কে উপেক্ষা করে তারা তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক কণ্যাকে বুকে টেনে নিয়ে নতুন করে বাঁচার রাস্তা দেখান। তাদের বাড়ির আশেপাশের প্রতিবেশীরা পূর্ণ সমর্থন জানায় মৌ এর বাবা মা কে। নিদারুণ এক দুঃস্বপ্ন থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়ায় মৌ।
   আর অতি চতুর অনুপমের চাকরি যায় ও তার বিরূদ্ধে কেস চলবার পর তার কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়।মনে হয় সারাজীবন জেলের অন্ধকারে থেকে তার কূট বুদ্ধি কিছুটা শুধরে যাবে। 

---সমাপ্ত---

                     লেখক পরিচিতি


 ১৯৫৯ এর ১৪ ই আগস্ট কলকাতায় জন্ম।পিতা স্বর্গত বিমলেন্দু বসু ,মাতা শ্রীমতি রেনুকা বসু।‌লেখাপড়ায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য, স্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটি তে অসাধরণ ফল (রেজাল্ট) করায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক বিজয়ী।এর পরে গবেষণায় পি এইচ ডি ডিগ্রি ও তৎপরবর্তী পোষ্ট ডক্টরাল কাজ উল্লেখযোগ্য। এরসঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষা বিখ্যাত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র র কাছে। বহুদিন কলেজের সঙ্গে যুক্ত, সঙ্গে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন। একাধারে প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণে উৎসাহী।