শহীদের পরিতাপ -- বিশ্বনাথ দাসচৌধুরী
শহীদের পরিতাপ
বিশ্বনাথ দাসচৌধুরী
এই আরেক মা হলেন ভারতমাতা, যে মায়ের বুকে আমি হয়েছি ভূমিষ্ঠ।
কানে আসে ক্ষুধার্ত জনগণের আর্তনাদ, চোখ মেলে দেখি ফ্যাকাসে আকাশ,
বাতাসও যেন বয়ে বেড়াচ্ছে কোটি কোটি অসহায় মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট নি:শ্বাস।।
দূরের একটি দেশীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি যেখানে আদর্শবান মানুষ হবার শিক্ষা দেয়;
যে শিক্ষা গৃহহীন মানুষকে আশ্রয় দেবার শিক্ষা -
যে শিক্ষা অভুক্ত মানুষের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেবার শিক্ষা -
যে শিক্ষা জাতিগত ভেদাভেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা -
যে শিক্ষা সাম্প্রদায়িকতার বীজ উপড়ে ফেলার শিক্ষা -
স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আদর্শে শিক্ষিত হয়ে দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খলমুক্ত করে বিশ্বের উচ্চাসনে বসানোর শিক্ষা।।
ছাত্রাবস্থায় যোগ দিয়েছি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে;
দিয়েছি হুংকার, ধরেছি অস্ত্র, খন্ডিত হতে দিইনি আমার বাংলাকে।
বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে ভর্তি হলাম মহাবিদ্যালয়ে বটে,
ভারতমাতার কান্না শুনে পড়াশোনায় ইতি টেনে শপথ নিলাম শৃঙ্খলমুক্ত করতে তারে।।
দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছি সাম্রাজ্যবাদীদের ভিত,
প্রশিক্ষণ নিয়েছি বোমা তৈরির, লুকিয়ে রেখেছি অস্ত্র, করেছি লিফলেট বিলি।
ধরা পড়ে খেটেছি জেল, পিছমোড়া করে মেরেছে লাথি, দিয়েছে বন্দুকের বাট এর বারি ওই উদ্ধত ইংরেজ পুলিশ;
তবুও পিছু হটিনি, বরং আরো বীর বিক্রমে জ্বলে ওঠার আশায় প্রহর গুনে গেছি।।
আইন অমান্য আন্দোলন করেছি, তুলে নিয়েছি হাতে বোমা;
হত্যা করেছি অত্যাচারী ইংরেজদের, নিয়েছি ভারতমাতার প্রতি যাবতীয় লাঞ্ছনার প্রতিশোধ;
তৈরি করেছি বিদ্যালয় গরীব ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের তরে,
পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি দেশ ও জাতি গঠনের মন্ত্রে দীক্ষিত করার লক্ষ্যে।।
বিয়াল্লিশ এর আন্দোলনেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বুঝে গেছে এদেশে তাদের মেয়াদ শেষ,
আন্দোলন হল আরো তীব্রতর, ঘরে বাইরে চললো লড়াই।
ফাঁসিকাঠে ঝুলেছি, হাসিমুখে করেছি মৃত্যুবরণ 'ভারতমাতা কি জয়' বলতে বলতে,
পেয়েছি শহীদের তকমা।
ভারতমাতা শৃঙ্খলহীন হয়েছে ওই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শৃঙ্খল হতে, পরিপূর্ণতা পেয়েছে আমার শপথ।।
কালের নিয়মে শাসনভার হস্তান্তর হলো ভারতীয় নেতৃত্বের হাতে।
দিনটি ছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট।
আপামর ভারতবাসীর জীবনে নূতন সূর্য উদয় হলো।
দিগন্তরেখার ওপার থেকে ভাবলাম তাদের জীবনের দুঃখের দিন শেষ।
এবার সুদিনের পালা, সাথে দেশ আর জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পালা।।
স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ পালন করছে গোটা দেশ মহা সাড়ম্বরে।
কিন্তু আমি ওপার থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নিরন্ন মানুষদের যারা ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খুঁজে বেড়াচ্ছে;
আমি ওপার থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি গৃহহীন মানুষদের যারা ফুটপাথে, গাছের তলায় দিনরাত্রিযাপন করছে;
আমি ওপার থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নিরক্ষর মানুষদের যারা এখনো বই খাতার মুখ পর্যন্ত দেখেনি;
আমি ওপার থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কর্মহীন মানুষদের যারা কোনো কাজ না পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই ভারতবর্ষের জন্যই কি আমি ফাঁসি কাঠে হাসি মুখে মৃত্যুবরণ করলাম!
আমি তো এই ভারতবর্ষ চাইনি যেখানে জাতপাতের লড়াই, সাম্প্রদায়িক হানাহানি জারি থাকবে;
আমি তো এই ভারতবর্ষ চাইনি যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র করে মাফিয়ারাজ তৈরি হবে;
আমি তো এই ভারতবর্ষ চাইনি যেখানে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে এক শ্রেণীর মানুষ দাপিয়ে বেড়াবে;
আমি তো এই ভারতবর্ষ চাইনি যেখানে রাজনীতিকদের একাংশ মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকবে;
ভারতমাতার চোখের জল কি তবে পড়তেই থাকবে?
না, শুধু পরিতাপ করলেই হবে না।
হে ঈশ্বর ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলো।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষকে অতল গহ্বর থেকে টেনে তুলতে ভারতমাতার বুকে আবার প্রেরণ করো সেই বিপ্লবীদের যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়েছিলেন।
সেই লেখকদের যাদের লেখনী বিপ্লববাদের জন্ম দিয়েছিল।
তবেই কিনা আমার আত্মা শান্তি পাবে।
ভারতমাতার মুখে হাসি ফুটবে।
<------সমাপ্ত------>
পরিচিতি
বিশ্বনাথ দাসচৌধুরী ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে উত্তরপ্রদেশের বারাণসী জেলার কাশীতে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তার বেড়ে ওঠা হুগলী জেলার কামারপুকুরে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা বিস্তারের সাথে নিবিড় ভাবে যুক্ত থাকা একটি পরিবারের সদস্য তিনি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা কামারপুকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন বহুমুখী বিদ্যালয়ে। ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিক। ২০০১ সালে উচ্চমাধ্যমিক এবং ২০০৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন কামারপুকুরে অবস্থিত শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা বিদ্যামহাপীঠ থেকে। অতঃপর সরকারী চাকুরির জন্য প্রস্তুতি এবং ২০০৭ সালে কলেজে ক্লার্কের পদে স্থায়ী ভাবে নিযুক্ত হন। ২০০১ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কামারপুকুর অঞ্চলের উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির মধ্যে আর্টস বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। খুব অল্প বয়সে টাইপ ও শর্টহ্যান্ডে বিশেষ ব্যুৎপত্তির জন্য ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এর কাছেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ, সন্ত মাদার টেরিজার স্নেহধন্য তিনি। একটা সময় তিনি কলকাতায় জাপানি ল্যাঙ্গুয়েজ একাডেমির ছাত্র ছিলেন এবং স্থানীয় গড়মান্দারনে অবস্থিত একটি মাদ্রাসায় আরবী ও উর্দু ভাষা চর্চা করেছেন। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক পত্রিকায় সারদায় ওনার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কলেজে পড়াকালীন বার্ষিক দিগন্ত পত্রিকায় ইংরেজি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে অবসর সময়ে প্রতিবাদমূলক কবিতা, প্রেমের কবিতা, সামাজিক কবিতা বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ ভাবে লিখেছে। কবিতা ছাড়াও উনি বিভিন্ন বিষয় যেমন অর্থনীতি, পরিবেশ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতির উপর ইংরেজি ভাষায় প্রবন্ধ লিখেছেন। ওনার লেখা পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটকের বিভিন্ন সংকলন, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতবর্ষের বাইরেও যেমন বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াতেও ওনার লেখা বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় গৌরবের সাথে স্থান পেয়েছে। উনি বিভিন্ন সাহিত্য সম্মানে ভূষিত হওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকা কমিটির সম্মানীয় পদ অলংকৃত করেছেন।
Join the conversation