ভাটপাড়া ভ্রমণ – ইতিহাসের খোঁজে - প্রবাল সেন
ভাটপাড়া ভ্রমণ – ইতিহাসের খোঁজে
প্রবাল সেন
ভাটপাড়ার সুনাম এক সময় দেশের কোনে কোনে ছড়িয়ে পড়েছিল সকল বিদ্যান পণ্ডিত মানুষজনেদের কাছে। এই ভাটপাড়ার বর্তমান অধিবাসী যারা ঐ সব বিদ্যান মানুষজনদের উত্তরসূরী হিসেবে আজও তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অনেক সুখময় স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। ভাটপাড়ার নামের উৎপত্তি হয়েছিল সেই সময় থেকে যখন বেশ কিছু শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পরিবার যাদের সকলেরই পদবী ভট্টাচার্য্য ছিল এখানে এসে বসতি স্থাপন করে থাকতে শুরু করেন। সেই সব ব্যাক্তিরা সংস্কৃত ভাষায় নানান পুরাণ পুস্তক পুঁথি অধ্যয়ণ করে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। সেই সব মানুষজনেরা সমস্ত সময় ধার্মিক পুঁথির অধ্যয়ণ এবং নিজেদের মধ্যে ধার্মিক আলোচনা করাই ছিল তাদের নিত্য নৈমত্তিক কাজ দূর দুরান্ত থেকে তাদের আমন্ত্রন আসতো ধর্ম নিয়ে সভায় আলোচনা ও তর্ক করার জন্য। সেই সব ধর্ম ও তর্ক সভা থেকে প্রায়শ তারা জয়ী হয়ে নানা পদবীতে ভূষিত হয়ে আসতেন বলে শোনা যায়। সুদুর দিল্লীতে বসে আমরা ভাটপাড়ার সুনামের কথা শুনতে পেতাম আমাদের ছোট বেলায় স্কুলের সহপাঠী সুভাষ ভট্টাচার্য্যের কাছ থেকে। আমরা সকলেই সেই সময়ের বাঙালীদের পরিচালিত স্কুলে পড়াশোনা করতাম। সকলে রোজ স্কুলে যেতাম ও স্কুল থেকে বাড়ী ফিরতাম একসঙ্গে পথে হেঁটে। সারা রাস্তা গল্প করতে করতে। আমাদের স্কুলেরর বন্ধুরা বেশীর ভাগই আমাদের পাড়ায় থাকতো। আমরা সকলেই থাকতাম গোল মার্কেট অঞ্চলে, সরকারী আবাসন গুলোতে। এক একটি পাড়ার নাম ছিল ব্রিটিশ জামানায় নানান ব্রিটিশ জেনারেলদের এবং উচ্চপদাধীকারী মানুষজনদের নামে। যেমন – লেকস্কোয়ার, রবাট ক্লাইভ, আউটট্রাম, লামস্ডন, ওয়েলিংডন , কর্নওয়ালিশ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুভাষরা থাকতো কর্ণওয়ালিস স্কোয়ারে আর আমরা থাকতাম লেক স্কোয়ারে। সুভাষের বাবা কাকারা ভাটপাড়া থেকে দিল্লী এসেছিলেন। সুভাষ এর মা ওর খুব ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। সুভাষের এক কাকা ছিলেন এবং সেই কাকার দুই ছেলে মেয়ে ছিল। দুজনেই আমাদের থেকে দু ক্লাস নিচুতে পড়তো। বোন আমাদের স্কুলে পড়তো না বলেই জানতাম। সুভাষের কাকিমাও খুবই অল্প বয়সেই মারা যান। সুভাষের বাবা কাকারা তাদের কম বয়সেই সরকারী চাকরী নিয়ে দিল্লী চলে আসেন। সুভাষ ছোট বেলা থেকেই জন্ম ও পরিবার সূত্রে খুবই মেধাবী ছিল। ও প্রতি ক্লাসেই প্রথম হয়ে উর্ত্তীন্ন হত। ওদের বাড়ীতে আমাদের খুব একটা যাওয়া আসা হত না তবে প্রতি সন্ধ্যায় পাড়ার বাঙালী লাইব্রেরীতে দেখা হত। ওর মুখ থেকেই আমরা ভাট পাড়ায় বসবাসকারি উচ্চ শিক্ষিত মানুষ জনেদের কথা শুনতাম। ওদের পূর্বপুরুষদের কথাও শুনতাম ওর মুখে। আমাদের স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষার শেষ হয়ে গেলে শুনেছিলাম ওরা আবার ভাটপাড়ায় পাকাপাকিভাবে ফিরে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর মারফৎ শুনতে পেয়েছিলাম যে ও আর আমাদের মধ্যে নেই।
একদিন সকাল সকাল বেড়িয়ে প্রথমে ঠিক করেছিলাম যে প্রথমে নৈহাটি রেল স্টেশনের কাছেই কাঠালপাড়াতে গিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চক্টোপাধ্যায় মহাশয়ের জন্ম ভিটে দেখে ভাটপাড়ায় ঘুরে আসব। কিন্তু আমার গন্তব্য স্থল কাঠ পুল যাওয়ার কথা হতেই একজন আমাকে তার টোটোতে নিয়ে নিল। এখানে বলে রাখা ভালো যে বঙ্কিমবাবুর বাড়ী যাওয়ার পথেই একটি কাঠপুল আছে আবার ভাত পাড়াতে ও আর একটি কাঠপুল আছে।
টোটোওয়ালা আমাকে কাঠালপাড়ার কাঠপুলে না নিয়ে গিয়ে ভাটপাড়ার কাঠপুল যাওয়ার জন্য মেন রাস্তার উপর নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। ওখান থেকে এক দেড় কিলোমিটার হাঁটা দিলাম কাঠপুলের দিকে। কাঠপুল গিয়ে জানতে পারলাম যে এই সেই কাঠপুল নয় – এটা ভাট পাড়ার কাঠপুল। একটা রাস্তার ধারে ছোট্ট চায়ের দোকানের দিদির সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলাম যে আজ ভাটপাড়ার দ্রষ্টব্য স্থানগুলো থেকে ঘুরে দেখে নেয়। ফেরার সময় অটো/ টোটো নিয়ে অল্প সময়ের ভীতর জগদ্দল ঘাট থেকে লঞ্চে নদী পার করে বাড়ী ফিরে আসবো বিকেল শুরু হওয়া আগে। সেই মতন দিদির দোকানে চা খেয়ে খুব কাছেই ২৫০-৩০০ বছরের প্রাচীন শিব মন্দিরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। বেশী দূর যেতে হল না ঠাকুর পাড়া পৌঁছে পঞ্চশিব মন্দিরের সন্ধান পেয়ে গেলাম। প্রত্যেকটি মন্দিরই সংরক্ষণ ও রঙ করে খুবই সুন্দর দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। তবে মন্দিরগুলির গাত্রে সে রকম আর বিশেষ কিছু পোড়া মাটির কাজ দেখতে পেলাম না। সবই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে দু একটা ছাড়া। এই মন্দির চত্তরে ছয়টি শিব মন্দিরের দেখা পেলাম। ছয়টি বড় শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে যেখানে নিত্য পূজা হয়ে থাকে। এখান থেকে বেড়িয়ে আর একটি বহু পুরাতন শীতলা মন্দিরের ও দর্শন পাওয়া গেল। এখানে আসার আগেই শুনেছিলাম যে আরও দুটো বহু প্রাচীন শিব মন্দিরের কথা। শীতলা মন্দির দেখে কাছেই এক রাজ বাড়ীর পাশ দিয়ে গিয়ে ঘোষ পাড়া রোডের পৌঁছে নদীর ঘাটের দিকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে চললাম। নদীর দিকে যে রাস্তাটি চলে গেছে তার নাম ভাঙা বাঁধা ঘাট রোড এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়টি (এখন হাইস্কুলে পরিণত হয়েছে) অমর কৃষ্ণ হাই স্কুল। এই বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেই দুটো ৫০০ বছরের পুরোনো শিব মন্দির দেখতে পেলাম। মন্দির দুটি মেরামত করে সুন্দর রং দেওয়া হয়েছে। এই মন্দিরের গায়ে ২৫০-৩০০ বছরের বেশ পুরনো পোড়া মাটির শিল্পের নিদর্শণ দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। পোড়া মাটির ফলকগুলি অনেকগুলিই অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে কালের নিয়মে। আমার এই ভাটপাড়া ভ্রমণের আরও একটা বিষয় নিয়ে লেখার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরে আর বলা হল না। পরে সময় ও সুযোগ হলে বলবো বিশদভাবে। শুধু এখন এইটুকু বলি যে আমি ভাটপাড়া এসে ভাগ্যক্রমে এক পরিবারের সঙ্গে আলাপ ও কথা হল তাদের বংশের পূজনীয় বাবা ঠাকুরদাদার নানান কর্ম কাণ্ডের বিসদভাবে জানতে পেলাম ঐ পরিবার বর্ত্তমান এক উত্তরসুরীর মুখে । কাছেই নদীর তীরবর্ত্তী পাকা বাধানো ঘাটে বেশ কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমরা বাড়ীর অভিমুখে রওয়ানা হয়ে পড়লাম।
পথ নির্দেশ – ভাট পাড়া যেতে হলে রেলে, বাসে (৮৫ নম্বর), টোটো বা অটোতে যাওয়া যেতে পারে। ঘোষ পাড়া রোডের থেকে ঠাকুর পাড়া রোড বা অঘোরনাথ হাই স্কুল ৫-১০ মিনিটের রাস্তা। এই স্কুলের সন্নিকটে বয়ে চলেছে হুগলী নদী।
-----সমাপ্ত-------
লেখক পরিচিতি
প্রবাল সেন
চন্দননগর, হুগলী
Join the conversation