জোহরবাহু প্রদেশ মালয়েশিয়া - প্রবাল সেন



    জোহরবাহু প্রদেশ মালয়েশিয়া
                   প্রবাল সেন



জোহর প্রদেশ মালয় দেশের দক্ষিণতম স্থানে অবস্থিত। এই জোহর প্রদেশের রাজধানী শহর হল জোহর বাহু। ঐ দেশের রাজধানী শহর কুয়ালালামপুর যেমন কে.এল.সিটি (KLC) নামেও সকলের কাছে পরিচিত সেই রকম জোহর বাহুও ঐ জোহর প্রদেশের মানুষজনদের কাছে শুধু জে.বি. (JB) নামেও পরিচিত। পাশ্ববর্ত্তী দেশ সিঙ্গাপুর থেকে মানুষজনদের মালয়শিয়ায় আসার জন্য জোহর প্রদেশই প্রবেশ পথ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এই জোহর বাহু অঞ্চলটি গত কয়েকশো শতাব্দী ধরে স্থানীয় সুলতান বংশীয় রাজাদের দ্বারা শাষন চলে আসলেও জোহর প্রদেশের আধুনিকত্ত ও বিকাশের প্রারম্ভ হয় ১৮৫৫ খ্রীঃ। সেই সময় সুলতান ইব্রাহিমের রাজত্বকালে প্রথম কোর্ট কাছারী, পুলিশ থানা ও অন্যান্য রাজ্য সুষ্ঠভাবে চালনা করার জন্য নানান সৌধ ও ভবনের স্থাপনা করা শুরু করেন। সুলতান রাজা ইব্রাহিমের পুত্র সুলতান আবু বাকার ১৮৬২ সনে সিংহাসনে আরোহন করেন। সুলতান আবু বাকার রাজ্যের রাজধানীর নাম পরিবর্তন করে রাখেন জোহরবাহু এবং রাজ্যের একটি নিজস্ব পতাকা প্রচলন করেন। ১৮৭১ খ্রীঃ এর পূর্বে এই রাজ্যের নাম ছিল ইস্কান্দার পুতেরী। পরবর্তী সময়ে সুলতান আবু বাকার রাজ্যের জন্য এক লিখিত আইনকানুন প্রারম্ভ করেন যা ছিল দেশের ভীতর। এই সময়কার বেশ কিছু সৌধালয় নির্মিত হয় নানা প্রান্তে। এই সব সৌধ গুলির স্থাপত্য শৈলী ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলিতে করা হয়েছিল। গত শতাব্দীর তিনের ডশকের সময় (১৯৩৬-১৯৩৯) সেই সব সৌধগুলিতে মালয় ও ইউরোপীয় নির্মান শৈলীর মেল বন্ধন করা হয়েছিল যা আজও দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়ের সৌধগুলি আকাশ চুম্বি উচ্চতম স্থাপত্য হিসেবে পরিগণিত হত বলে জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জাপানীরা মালয় দেশকে তাদের দখলে নিয়ে নেয় সন ১৯৪১ সালে তখন এই সৌধভবনগুলোকে জাপানী সেনারা তাদের দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করে ছিল। ১৯৪৫ সনে ব্রিটিশ শাষকরা মালয় দেশের শাষন ব্যবস্থা পুনোরুদ্ধার করে জাপানীদের থেকে তখন আবার এই সব সৌধগুলিতে বড় বড় দপ্তর, আইন সভা, মন্ত্রীদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত করতে শুরু করে। এই রকম ব্যবস্থা চলতে থাকে এই শতাব্দীর প্রথম দশকের সময় পর্যন্ত। জোহর বাহু মালয়শিয়া রাজ্যে মালয়শিয়া দেশের দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা পছন্দের স্থান কুযালালামপুর শহরের পর বিশেষ করে দেশীয় এবং বিদেশীয় পর্যটকদের কাছে। জোহরবাহুর অবস্থিতি সিঙ্গাপুর থেকে খুবই কাছে হওয়ার দরুন বহু মানুষজন যারা সিঙ্গাপুর দেশে কাজ করেন তারা প্রতি সপ্তাহের শেষে নদী পার করে জোহরবাহু তে এসে Week end কাটিয়ে যান। জোহরবাহুর জিনিষপত্রের দাম সিঙ্গাপুর অপেক্ষায় বেশ কম বলে তারা মনে করে থাকেন। এই ‘জে বি’ শহরে পর্যটকদের কাছে বিশেষ বেশী কিছু না থাকলেও সিঙ্গাপুর এবং অন্যান্য দেশ থেকে এখানে একদিন বা দুদিনের জন্য খুবই আকাংক্ষিত ভ্রমণের স্থল। আমরা যেমন মালয়শিয়ার কুযালালামপুর এসে এবং থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে জোহরবাহুতে দুদিন থাকার পর সিঙ্গাপুরের দিকে নদী পথে যাত্রা করেছিলাম। এখানে বিভিন্ন ধরণের হোটেল আছে থাকার জন্য। থাকার খাওয়ার খরচ ও তুলনামূলক ভাবে বেশ কম। কুযালালামপুর থেকে বাস বা ট্রেনে এখানে আসা যায় খুব সহজে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ তো আছেই। আমরা অবশ্য কুযালালামপুর থেকে ডিলাকস বাসেই এসেছিলাম। আমাদের এখানে দুইদিন থাকার জন্য হোটেল আগেই ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল। কুযালালামপুর থেকে আড়াই তিন ঘন্টার বাস যাত্রা খুবই সুখদায়ক ছিল। সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড থেকে হোটেলে পৌচ্ছে সব জিনিষ পত্র ঠিক ঠাক যায়গায় রেখে কাছেই শতাধিক বৎসরের পুরোনো একটা চায়ের দোকানে (চাইওয়ালা এন্ড কোঃ) গিয়ে খুব জম্পেশ করে আমরা চা মনোরম তৃপ্তির সঙ্গে আস্বাদ নিয়ে দোকানটির থেকে রাস্তায় বেড়িয়ে নেমে ডাউনের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে দেখলাম একটা সুউচ্চ লম্বা অট্টালিকা দেখা গেল। ওটাই হচ্ছে এখানকার একটি শহরের সব চেয়ে পুরোনো মল। খুব সম্ভবত ১৯৯৮ সনে এই মল বিল্ডিংটি তৈরি হয়েছিল। এখানে যদিও আরও বেশ কয়েকটা নতুন মল তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক কালে কিন্তু এ শহরে যারাই আসেন তাদের পছন্দের মল হল এই সবচেয়ে পুরাতন মলটি। যে যেখানেই থাকুন না কেন একবার বা তারও বেশী এই পুরাতন মলে এসে ঘুরে জিনিষ কেনা কাটা করে নিয়ে যাবেন। কথায় আছে না – Old is Gold। কথাটি এই পুরাতন মলের ক্ষেত্রে একশো ভাগ ঠিক বলেই সকলেই মনে করে থাকেন। এখানকার জ্যামজ্যাম বেকারী ও প্রসিদ্ধ। এই বেকারী পাকা কলার কেক প্রস্তুত করে যা খেয়ে দেশী বিদেশী খাদ্য রসিকদের কাছে খুবই নাম করেছে। আমরাও একদিন জ্যামজ্যাম বেকারীতে এসে পাকা কলা দিয়ে বানানো কেক খেয়ে আমাদের রসনার তৃপ্তি করে নিলাম। এই ‘জে বি’ শহরে সন্ধ্যেবেলায় সুন্দর রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যাওয়া যায় এবং রাস্তার ধারে ফুড কোর্ট (Food court) এবং ছোট ছোট খাওয়ার স্টলে গিয়ে নানান রকমের খাবার খেয়ে নিয়ে রাতের খাবার স্কিপ করে হোটেলে গিয়ে সে রাত্রিরের মতন বিশ্রামে চলে যেতে ছাড়া অতি ক্লান্ত পা দুটো আর কিছু মানতে চায়নি। মালয়শিয়া দেশের অন্যান্য ছোট ও বড়ো শহরের মতন এখানেও নানা ধর্মের এবং জাতের বাস বহু যুগ ধরে। স্থানীয় মালয়বাসীরা মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও চীন, ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে আগত বৌদ্ধ হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ও খুব একটা কম নয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের যেমন উপাসনার জন্য মসজিদ আছে সেই রুপ বৌদ্ধদের হিন্দুদের ও শিখদের বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির এবং শিখদের গুরুদ্বোরাত্ত এখানে দেখতে পাওয়া গেল। হিন্দুদের একটি শতাধিক বৎসরের প্রাচীন মন্দির ‘শ্রী রাজলক্ষী মন্দির’। এখানে নতুন স্ট্রীটে যেমন পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ভবনের সাথে নতুন নতুন আধুনিক নির্মাণ শইলিতে ভবনেও একই সাথে দেখতে পাওয়া যায়। ‘JB’ শহরে যেটা সর্বাপেক্ষা প্রাসঙ্গিক হলো এই শহরের রাস্তা ঘাট খুবই সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত এবং পরিচ্ছন্ন। রাস্তা ঘাটে গাড়ী বাস বা অন্যান্য চার ও দু পা ওয়ালা যান ছাড়া মানুষের দেখা বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে সন্ধ্যের পর থেকে একেকটা যায়গায় রাস্তা ঘাটে প্রচুর গাড়ীর যাওয়া আসার থাকার দরুন যানবাহনের বড় একেকটা জ্যাম লেগে থাকে। এই সমস্যাটি আরও বিশেষভাবে প্রকোপ হয়ে থাকে শনি ও রবিবার ছুটির দিনগুলিতে। সেই সময় অনেক অনেক যুবক যুবতী সিঙ্গাপুর থেকে বেড়াতে আসে ‘JB’ শহরে তাদের সাপ্তাহিক বিনোদনের জন্য। এখানে একটা জিনিষ আর একবার বললে ভালো হয় যে জোহর বাহু (‘জে বি’) শহরে জিনিষপত্রের খাওয়া দাওয়া সমেত থাকার খরচ সিঙ্গাপুর অপেক্ষা বেশ কম এবং জ্বালানি খরচা ও কম বলে ঐ দেশ সিঙ্গাপুর থেকে ছুটি ছাটার দিনে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেড়ে যায়। জোহর বাহুতে রাস্তার ধারে স্টলের সারিতে নানান সুস্বাধু খাওয়ার পাওয়া যায় অধিক রাত পর্যন্ত। এই খাবারের অন্বেষনে পাশ্ববর্তী দেশ সিঙ্গাপুর থেকে বহু মানুষজনেরা সপ্তাহের শেষে শনিবার ও রবিবার বা অন্য ছুটির দিনে এই সব খাবারের স্টলে ভীড় করে খাবার উপোভোগ করে থাকেন। জোহর বাহুতে মলগুলির আশেপাশেও অনেক রেস্টুরেন্টেও সারা রাত খোলা পাওয়া যায় বছরের সব সময়ই দেশীয় ও বিদেশীয় পর্যটকদের জন্য। জানা যায় এই সব খাবার খুবই মুখ্রোচক এবং দামেও সস্তা। গত কয়েক দশক ধরে জোহর বাহু (‘JB’) পর্যটকবান্ধব স্থান হিসেবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।         

                     ------সমাপ্ত------


                    লেখক পরিচিতি 


প্রবাল সেন - জন্ম দেশের রাজধানী দিল্লি ১৯৪৮ সনে। ছোটবেলা থেকে বড়ো হয়ে ওঠা এবং পড়া শোনা সবই বাঙালি পরিবেশে । চাকুরী জীবন শুরু হয় মীরাট শহরে । কর্ম উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে গমন ও থাকা । সেই সব স্থানের মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পরিভ্রমণ কে পাথেয় করে আমার সাহিত্য জগতে প্রবেশ । মূলত ভ্রমণ কাহিনী লিখলেও গল্প, জীবনী এবং স্মৃতি চারণ নিয়েও লেখালেখি করে থাকি ।
পেশা ভিন্ন হলেও নেশা আমার দেশ বিদেশ দেখা । বর্তমানে হুগলির মহকুমা শহর চন্দননগরে পাকাপাকি ভাবে থাকা হয়।