জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা
জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা
শাস্ত্র এবং ইতিহাস বিশ্লেষণ করে রথযাত্রা সম্পর্কে যেটা জানতে পারলাম তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী তুলে ধরার চেষ্টা করলাম ।
উৎপত্তি ও আভিধানিক অর্থ
রথযাত্রা দুটি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, ‘রথ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অক্ষ, যুদ্ধযান বা কোনোপ্রকার যানবাহন অথবা চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা হালকা যাত্রীবাহী গাড়ি। এবং যাত্রা হলো কোথাও গমন, অতিবাহন বা তীর্থযাত্রা।
অন্যদিকে জগন্নাথ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ “জগৎ” বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু”। “জগন্নাথ” কথাটি তৎপুরুষ সমাস। এটি “জগৎ” ও “নাথ” শব্দের সংমিশ্রণ গঠিত। যেমন “জগৎ” (যার মূল ধাতু “গম্”, অর্থাৎ “যা কিছু চলে”) এবং (“নাথ” অর্থাৎ, প্রভু বা আশ্রয়) শব্দটির সংমিশ্রণে গঠিত। সুতরাং “জগন্নাথ” অর্থ “যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আশ্রয় চলমান জগতের আশ্রয়দাতা অর্থাৎ প্রভু”।
সূচনা ও প্রচলন
রথযাত্রার সূচনা প্রায় হাজার বছরের পুরনো। ইতিহাস অনুযায়ী, ওড়িশার গঙ্গ রাজবংশ এবং পরবর্তী গজপতি রাজারা পুরীতে রথযাত্রা উৎসবের প্রচলন করেন।
এই উৎসবটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের (জগন্নাথ রূপে) জন্ম এবং দারু কাঠ দিয়ে তাঁর মূর্তি তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত।
রথযাত্রা উৎসবে ভগবান জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা গুন্ডিচা মন্দিরে যান, যা গুন্ডিচা রাজার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
পুরাণ অনুযায়ী, রথে করে ভগবান জগন্নাথের সফর মূলত তাঁর মা গুণ্ডিচার ঘরে যাওয়ার প্রতীক।
ধারণা করা হয় যে, রানী গুন্ডিচা এই উৎসব আয়োজনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন, যাতে দরিদ্র ও সকল বর্ণের মানুষ এই উৎসবে অংশ নিতে পারে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পুরী ভ্রমণের পর বাংলায় রথযাত্রার সংস্কৃতি প্রসার লাভ করে এবং বৈষ্ণবরা পুরীর অনুকরণে রথযাত্রা শুরু করেন।
তবে অন্য কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে, এই উৎসবটি রাজা অনন্তবর্মণ চোদাগঙ্গা দেবের সময় থেকে শুরু হয়েছিল, যিনি জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
শ্রীরামপুরের মাহেশে ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রথযাত্রা পালিত হচ্ছে, যা পুরীর পরেই দ্বিতীয় প্রাচীনতম রথযাত্রা।
পরবর্তীতে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ বিশ্বজুড়ে রথযাত্রা উৎসবের প্রচলন করেন।
উৎসবের তাৎপর্য
রথযাত্রা ভক্তদের জন্য আনন্দ ও ভক্তির এক বিশাল উপলক্ষ।
এই উৎসবে, ভক্তরা রথের রশি ধরে টানেন, যা একটি অত্যন্ত পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়।
ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, রথের রশি স্পর্শ করলে বা টানলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয় এবং পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
রথযাত্রা উৎসবটি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত, যা সমাজে একতা ও সাম্যের বার্তা বহন করে।
রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া একটি আষাঢ় মাসে আয়োজিত অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। ভারতের ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে এই উৎসব বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। বাংলাদেশের নড়াইল জেলার ঐতিহ্যবাহী কালিয়া উপজেলার কালিয়া সেন বাড়ীতে অবস্থিত কালিয়া রথ খোলা মন্দির একটি অতি প্রাচীন এবং সুনামধন্য রথ মন্দির। এখানে রয়েছে পিতলের তৈরি রথ মূর্তি।
এই রথ মন্দির তথা রথ খোলার সাথে অনেক সুনামধন্য বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মৃতি বিজড়িত রয়েছে । এই রথ খোলা সম্পূর্ণ মন্দির কমপ্লেক্স টা ছিল মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মামা বাড়ী অর্থাৎ সুচিত্রা সেনের মাতা এই রথ খোলা মন্দির কমপ্লেক্সেই জীবনের প্রথম দিকের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছেন , এই কমপ্লেক্সেই শৈশব জীবনের বেশ কিছু টা সময় অতিবাহিত করেছেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনও।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা জরুরি এটা হলো , রথ খোলা মন্দির কমপ্লেক্স বলছি এই কারণেই যে, এখানে শুধুমাত্র একটা রথ মন্দির নয় , এখানে রয়েছে দুর্গা মন্দির, শিব মন্দির সহ মোট পাঁচটি মন্দির এবং বসবাসের জন্য ১২ টি বড় বড় ভবন।
এই কমপ্লেক্সেই একাধিক বার রাত্রি যাপন করেছেন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক ঔপন্যাসিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই কমপ্লেক্সেই সময় অতিবাহিত করে গিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন নাথ দত্ত সহ অসংখ্য গুণীজন।
জন শ্রুতি আছে যে, ১৯৩১ সালের কাছাকাছি কোনো একদিন এক সমাবেশে স্বল্প সময়ের জন্য একবার এই কালিয়া তথা এই মন্দির কমপ্লেক্সে এসেছিলেন অখণ্ড ভারতের রাষ্ট্র নায়ক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু । নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর , জগৎ বিখ্যাত সেতারা বাদক রবি শংকর , বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক কমল দাস সেনগুপ্ত, কবি ও লোকশিল্প প্রফুল্ল গোঁসাই , হরি ভক্ত শ্রী মৃত্যুঞ্জয় গোঁসাই সহ অখণ্ড ভারতবর্ষের অসংখ্য গুণীজন এই কালিয়া তে জন্ম নিয়েছেন , শৈশব জীবন অতিবাহিত করেছেন।
এই কালিয়া জনপদের ইতিহাস, ঐতিহ্য অন্য আরেক দিন বলবো ।
ভারতের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, শ্রীরামপুর শহরের মাহেশের রথযাত্রা, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ, কলকাতার রথ এবং বাংলাদেশের ইসকনের রথ ও ধামরাই জগন্নাথ রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ।
<----------------সমাপ্ত--------------->
জয় জগন্নাথ তোমাকে প্রমাণ
🙏🙏🙏
সম্পাদনায়
গোপেশ কুমার মন্ডল
গৌর সাহিত্য পত্রিকা
গোপেশ কুমার মন্ডল
গৌর সাহিত্য পত্রিকা
www.goursahityapatrika.in
1 comment